৭১-এর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে ৫৪ বছর হয়ে গেল, কিন্তু আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিশ্বে বা জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হয়নি। তবে ’২৪-এর গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘ-তথ্যানুসন্ধান দল প্রতিবেদন দিয়েছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা এবং সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ। ১১৪ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে নৃশংসতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিগত সরকার ও শাসক দল আওয়ামী লীগকে পদ্ধতিগতভাবে দায়ী করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংগঠন এবং বিভিন্ন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
এই প্রতিবেদন তৈরির জন্য ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া, সিলেট ও গাজীপুর- এই আট শহরে অনুসন্ধান চালায় জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দল। মূলত যেসব স্থানে বেশি মাত্রায় বিক্ষোভ হয়েছিল, সেসব স্থানে সরজমিন কাজ করে জাতিসংঘের দলটি। প্রতিবেদন তৈরিতে অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঘটনার সাক্ষী ব্যক্তিদের নিয়ে ২৩০টির বেশি সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আরও ৩৬টি সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। এই ৩৬ জনের মধ্যে সরকারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারাও আছেন, যারা ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
তৎকালীন সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা, আওয়ামী লীগের সহিংস গোষ্ঠী ও সংগঠন পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল। যার মধ্যে রয়েছে কয়েকশ’ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হাজার-হাজার বিক্ষোভকারীকে গুরুতরভাবে শারীরিক নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগ, ব্যাপকহারে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক এবং নির্যাতনসহ অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন। ওএইচসিএইচআর যুক্তিসঙ্গত কারণে বিশ্বাস করে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা, সমন্বয় ও নির্দেশনায় এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ঘটেছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ই আগস্টের আগে ১৮ই জুলাই সন্ধ্যায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি ‘কোর কমিটি’র বৈঠক হয়, যেখানে পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবি প্রধান ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে বিজিবি কমান্ডারকে আরও দ্রুত প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেন।
প্রতিবেদন তৈরিতে যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে- তাদের অনেকেই জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের একদিন পরেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক ডাকেন। যেখানে তিনি বিক্ষোভ দমনের জন্য বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে বলেছিলেন এবং বিশেষভাবে ‘বিক্ষোভের মূলহোতা’ বা ‘গণ্ডগোল সৃষ্টিকারী’দের গ্রেপ্তার, হত্যা এবং হত্যার পর লাশ লুকিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুতরাং বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ সম্পর্কিত বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের তথ্য-অনুসন্ধান প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত এবং প্রমাণিত অপরাধী। দেশের নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে ক্ষমতায় থাকার বাসনা শেখ হাসিনাকে এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। বিশ্বমানবতার সম্মুখে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত প্রমাণিত হওয়ার পর শেখ হাসিনার রাজনীতির সমাপ্তি ঘটে গেছে। ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার স্বার্থে, অবৈধ ক্ষমতা দখলে রাখার স্বার্থে এবং ক্ষমতার উন্মাদনায় অনুসারী ঘাতকদের দুষ্কর্মের নির্দেশদাতা হয়ে শেখ হাসিনার রাজনীতি এবং বেঁচে থাকা দু’টোই জটিল হয়ে পড়েছে।
এককালে গণতন্ত্রের মানসকন্যা, মানবতার জননী নামধারী শেখ হাসিনা নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে দলকেও যুক্ত করে ফেলে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযানে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশের সহিংস প্রচেষ্টাকে সাহায্য করতে, অভিযান শুরুর আগেই সশস্ত্র আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা পুলিশের সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল অথবা পুলিশ ফোর্সের পেছনে থেকে আক্রমণে অংশ নিয়েছিল। পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা লোকজনকে থামিয়ে তল্লাশি চালিয়েছিল, বিক্ষোভকারীদের আটক করেছিল এবং সংঘটিত ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিল।
প্রতিবেদন তৈরিতে ওএইচসিএইচআরকে কিছু পুলিশ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের ৯৫ জন সদস্যের নাম এবং তাদের ভূমিকা কী ছিল তার বিস্তারিত সরবরাহ করে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশের মতে, এই ব্যক্তিরাই বিক্ষোভের সময় সহিংস হামলায় ব্যবহারের জন্য তাদের অনুগতদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। অস্ত্র সরবরাহ যাদের করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ১০ জন তৎকালীন সংসদ সদস্য, ১৪ জন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, ১৬ জন যুবলীগ নেতা, ১৬ জন ছাত্রলীগ নেতা।
নিহতদের মধ্যে ১২১৩ শতাংশ শিশু বলে জানা গেছে। পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের টার্গেট করে হত্যা করেছে, ইচ্ছাকৃত ভাবে পঙ্গু করেছে, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অমানবিকভাবে আটক-নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন করেছে। বিশেষ করে, শুরুর দিকে বিক্ষোভের সম্মুখসারিতে থাকা নারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা মারাত্মকভাবে আক্রমণ করেছে।
গণহত্যায় অভিযুক্ত হয়েও শেখ হাসিনা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন, গুরুতর মানবতা লঙ্ঘনের প্রশ্নে তিনি কতো বড় অপরাধী। তিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তার নির্দেশে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিচারে পাখির মতো গুলি করে ছাত্র-জনতা হত্যা করেছে। কীভাবে সংঘটিত হয়েছে মর্মান্তিক পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ! বিপজ্জনক শেখ হাসিনার পক্ষে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য আর কিছুই করণীয় নেই। হাসিনার সামনে এখন দু’টি পথ খোলা আছে- হয় আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করা, নয় তো বিদেশে পালিয়ে থাকা। একদিন এদেশের জনগণ তার জীবন রক্ষা করেছে এবং মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচিয়েছে। আর পরবর্তীতে তিনি নিজেই দেশের জনগণকে হত্যা করে লাশ লুকিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। এটাই তার কৃতজ্ঞতাবোধ! যে আওয়ামী লীগ তাকে দলের সভাপতি করেছে, সেই দলকেই গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করার রসদ জুগিয়েছে। সব সময় তিনি ক্ষমতা ধরে রাখা এবং চিরস্থায়ী করার জন্য নিজের স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছেন। সময় সুযোগ পেলেই পিতা হত্যার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি ও দলের প্রতি ঘৃণার গরল ছড়িয়ে দিতেন।
সর্বাত্মক স্বার্থান্ধ শেখ হাসিনার সামনে কেবল নিকষ অন্ধকার। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ইত্যাদির ব্যাপক মিথ্যাচারের বয়ান খান খান হয়ে গেছে। ’২৪-এর জুলাই গণহত্যা হচ্ছে বর্বরতার নাম। গণহত্যায় অভিযুক্তরা বিষাক্ত বাস্তব অবস্থানে বাইরের রূপটা পরিবর্তন করে থাকে। সব পুরনো সাপগুলো খোলস ছাড়ে, ভবিষ্যতকে উপহাস করে। নরহত্যার তাণ্ডবকে শেখ হাসিনা এখনো গৌরবময় মনে করে। হত্যার নির্দেশ কার্যকর হলে আত্মপ্রসাদ লাভ করে নিজেকে অভিনন্দন জানাতেন তিনি। নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যার জন্য, গুলিতে বুক ঝাঁঝরা করার জন্য, আয়না ঘরের দুর্দশার জন্য নিজেকে তিনি অভিশপ্ত মনে করেন না। অনুশোচনার লেশমাত্রও তার মাঝে নেই। রাষ্ট্রক্ষমতাই একমাত্র আরাধ্য।
শেখ হাসিনা এসব করেছে সজাগ ও সচেতনভাবে। তিনি নিজেই নিজেকে এবং দলকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছেন। অথচ সংকটের এই গভীর সময়েও বিব্রত এবং সংযত হওয়ার বিশেষ চারিত্রিক গুণটি আয়ত্ত করতে পারছেন না, এখনো মনে হয় ক্ষমতার মসনদে বিচরণ করছেন। এখনো কথার মালা জপতে-জপতে অতীতের মতোই কথা বলেন। কোনো অনুতাপ নেই, নেই কোনো আত্ম-জিজ্ঞাসা। এখনো সত্য আর গণহত্যাকে অস্বীকার করে বক্তব্য দিয়ে তিনি মানুষ হত্যার অধিকার ফিরে পেতে চাচ্ছেন। এ যেন অক্ষমের এক আস্ফালন। দুর্ভাগ্যের কবলে পড়ে পলায়ন করেও ন্যূনতম শিক্ষা শেখ হাসিনা গ্রহণ করেননি। তার ললাটে গণহত্যার সিলমোহর লেগে গেছে। ইতিহাসে গণহত্যাকারী হিসেবে শেখ হাসিনার স্থান নির্ধারিত হয়ে গেছে। অনন্তকালের জন্য ইতিহাসের মর্মরপ্রস্তরে তার নাম অমোচনীয় কালিতে খোদাই হয়ে গেছে। এখন তাকে ভারতের করুণার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়, তবু আত্মম্ভরিতা পরিত্যাগ করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে দল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ ও ভয়াবহ হত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই আওয়ামী লীগ ২৪-সালে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত।
গণহত্যাকারীরা বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে উপহাস আর বিদ্রূপের পাত্র। এ ছাড়া গণহত্যাকারীদের আর কোনো উপায় থাকে না। সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব-রাজনীতির কেউই তাদেরকে গ্রহণ করে না। নিষ্ফল আক্রোশে গর্জন করে আর লাভ নেই। শেখ হাসিনার সব আশা চিরদিনের মতো তলিয়ে যাবে নিশ্চিহ্নভাবে। নিজের কৃতকর্মের পাপে শেখ হাসিনা এখন চূড়ান্ত দুর্ভাগ্যের প্রান্ত সীমায়। নিশ্চয়ই একদিন আত্মপীড়নের ভয়াবহ যন্ত্রণা তাকে অতিক্রম করতে হবে এবং হাজার-হাজার শহীদের মায়ের আহাজারি শেখ হাসিনার অস্তিত্বের ভিত্তিভূমিটাকে কাঁপিয়ে দেবে। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার বাসনায় মানুষ হত্যার রাজনীতি তাকে গভীর অতলান্তিক খাদের অন্ধকারে ফেলে দিয়েছে। পৃথিবীতে সূর্য কিরণ দিতে থাকবে কিন্তু শেখ হাসিনার আলো চিরতরে নিভে গেছে। বার্ধক্যের এই জীবন সায়াহ্নে এসে মৃত্যুর হাতছানি দেখেও শেখ হাসিনার বিবেক জাগ্রত হবে-এমন আশা আর করা যায় না। এরপরেও আওয়ামী লীগ বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ধরে রাখা কতো অমর্যাদাকর। বাংলাদেশ, ফ্যাসিবাদ ও গণহত্যাকারীর বিরুদ্ধে সুরক্ষিত দুর্গে পরিণত হয়ে অপরাজেয় হয়ে উঠেছে।
জুলাই গণহত্যার শিকার যারা, তারা মৃত্যুর থেকে মহিয়ান ও বলবান। তারা নির্বিচার গুলির সামনে দাঁড়িয়ে উপহাস করেছে স্বয়ং মৃত্যুকে। তাদের উজ্জ্বলতম জাতীয় গৌরব ইতিহাসের পাতায়-পাতায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লক্ষ-কোটি জনতা চিরকালই এগিয়ে যাবে অকুণ্ঠ ও নির্ভীকভাবে। প্রজাতন্ত্রের মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য অসংখ্য প্রাণ বরণ করে নেবে গৌরবময় মৃত্যু। মৃতদের উপস্থিতি এবং জীবিতদের প্রেরণা বিজয়-গৌরবে অজেয় করে তুলবে আমাদের এই মাটিকে। প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক।
আপনার মতামত জানানঃ