সংবিধানে ‘ফিরছে’ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা। তবে সেটি বিলুপ্ত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নামে ফিরবে, নাকি ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ হয়ে আসবে– তা এখনও পরিষ্কার নয়। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়া গঠিত কমিটির মাধ্যমে হবে, নাকি আদালতের রায়ে ফিরবে– সেটিও অস্পষ্ট। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোরও রয়েছে ভিন্ন মত।
গতকাল রোববার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদনের জন্য বিএনপি আদালতে গেলে আগামী বৃহস্পতিবার শুনানির দিন ধার্য করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এই শুনানি হবে। তবে অন্য দলগুলো এই দাবির পক্ষে একমত পোষণ করলেও রিভিউ আবেদনের সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত নন। সংবিধান সংস্কারে বর্তমান সরকার গঠিত কমিশন এ বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ করবে বলে তারা মনে করছেন।
তবে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক মনে করেন, আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই। কারণ, এটি বাতিল হয়েছিল জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে। যদিও পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে আদালতে একটি রিট করা আছে। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে ফিরে আসতে পারে।
প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নির্বাচন পদ্ধতি। নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে, নাকি অনির্বাচিত নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে– এ নিয়ে দফায় দফায় উত্তাপ ছড়িয়েছে দেশের রাজনীতি। এমন বিতর্কের অবসান হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। তখন প্রবল বিক্ষোভের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে ক্ষমতাসীন বিএনপি। কিন্তু ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে এই নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করে দেয়।
এর আগে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চারটি সংসদ নির্বাচন হয়। তবে সে সময়ও এই ব্যবস্থার বেশ কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করেছিল রাজনৈতিক দলগুলো। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক প্রধান কে হবেন– তা নিয়ে আদালতের রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতির পদকে বাদ দেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বিএনপির সঙ্গে তাঁর দল এতদিন যে আন্দোলন করেছে, সেটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ছিল না। সেটি ছিল অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, সেই সরকার প্রতিষ্ঠা এখন সম্ভব হয়েছে। এখন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই সরকার ঠিক করবে পরবর্তী নির্বাচন কীভাবে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি আদালতে আবেদন করলেও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে তারা নেই। আদালত কী সিদ্ধান্ত দেয়, তা দেখে তার দলের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করবে।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আগে যদি পরপর তিনটি নির্বাচন এই ব্যবস্থায় করা যেত, তাহলে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্যে দেশ চলে আসত। দেখা গেল, ক্ষমতাসীনরা এটা রক্ষা করেনি, পরে আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থা বাদ দিল। যেটি বর্তমান সংকটের অন্যতম কারণ। বিএনপির সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মাধ্যমে একটি সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি বলেন, এই ব্যবস্থা নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে ফিরিয়ে এনে সরকারের কাজ সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। তাহলে তারা শুধু নির্বাচনী কাজেই জড়িত হবে, নির্বাচনের পর চলে যাবে।
তিনি বলেন, আদালতের রায়ের মাধ্যমে এটি ফিরে আসতে পারে, সেখানে আদালত সুনির্দিষ্ট করে দিতে পারে এই সরকারের কাজ। এ বিষয়ে আমাদের দলের মতামত নেওয়ার জন্য আদালত ডাকলে সিপিবি গিয়ে দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করবে।
তবে এ মুহূর্তে রাজনীতির মাঠে সবচেয়ে আলোচিত দল জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে দলীয় ফোরামের সিদ্ধান্ত আমার জানা নেই।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু জানিয়েছেন, তাঁর দলও মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। আদালতে বিএনপি যে রিভিউ আবেদন করেছে, সেটি তিনি শুনেছেন। তবে এ বিষয়ে দলীয়ভাবে জাপা এখনও কোনো আলাপ-আলোচনা করেনি। আজ সোমবার জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। সেখানে এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে পারেন।
তবে চুন্নু ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার যে দুর্বলতা ফুটে উঠেছে, সেগুলো আমলে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের কাজ সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচনে ব্যর্থ হলে কী হবে, তাও আইনে উল্লেখ করে দেওয়া উচিত।
যদিও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়টি বেআইনি ছিল। সে কারণেই বিএনপির পক্ষ থেকে রিভিউ আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু আগামী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে এবং তার প্রক্রিয়া কী হবে, সেটি ঠিক করবে বর্তমান সরকার। সংবিধান সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে কমিশন গঠনও করেছে।
২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে করা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে সংসদ চাইলে পরবর্তী দশম ও একাদশ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলেও রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ রায় দিয়েছিলেন। এর পর বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে এর আলোকে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়ন করে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২৫ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল-সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। বাকিরা হলেন– তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজ উদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। তাদের পক্ষে অ্যাডভোকেট শরীফ ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওন রিভিউ আবেদন করেন। অন্যদিকে গত ১৬ অক্টোবর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষেও আপিল বিভাগে আরেকটি রিভিউ আবেদন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হলে দিন ধার্য করেন চেম্বার আদালত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্ক
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পরই সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ করা হয়েছিল। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর নেওয়ার বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৬৭। এর পেছনে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ইচ্ছা লুকায়িত ছিল বলে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে। কারণ, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু ছিল। সংবিধান অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। ২০০৩ সালে জুনের শেষের দিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান কে এম হাসান। তখন অভিযোগ উঠেছিল, বিএনপি সরকারের পছন্দের কারণেই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে কে এম হাসানকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান অবসরের পরপরই যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন।
আওয়ামী লীগের সহিংস আন্দোলনের মুখে বিচারপতি কে এম হাসান ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সংবিধান অনুযায়ী সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব না নিলে তাঁর আগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা। এভাবে চারটি বিকল্প ছিল সংবিধানে। কেউ দায়িত্ব নিতে না চাইলে সর্বশেষ উপায় হিসেবে রাষ্ট্রপতির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু সংবিধানের সব বিকল্প না দেখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।
রাষ্ট্রপতি বিএনপির মনোনীত হলেও তিনি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেন, তখন আওয়ামী লীগ সরাসরি আপত্তি করেনি। তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে, তিনি বিএনপির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছেন। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে চারজন সদস্য পদত্যাগ করেন। শুরু হয় আরেক সংকট।
আওয়ামী লীগ এবং অন্য বিরোধী দলগুলোর তীব্র আপত্তির মুখেও ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দেয়। সেনাবাহিনীর সমর্থনে গঠিত হয় নতুন আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তিন মাসের বদলে সেই সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন দেয়। এর পর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তিনটি ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই তিন নির্বাচনই ছিল বিতর্কিত।
আপনার মতামত জানানঃ