জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের রাস্তায় পুড়ে যাওয়া ফিলিস্তিনি মানুষ, পোড়া তাঁবু, লাশের স্তূপ। ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে ধুলায় দিশাহারা জীবিত ব্যক্তিরা তাঁদের ছোট বাচ্চাদের প্রাণহীন লাশ নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। পশ্চিমা কোনো সংবাদমাধ্যমে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এই গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন? গাজা বা লেবাননে ইসরায়েল সংঘটিত যুদ্ধসন্ত্রাসের ছবি পুলিৎজার পুরস্কারের মনোনয়ন পায় না, পাবেও না। কারণ, সম্পাদকেরা ভয় পান।
গিওরা এইল্যান্ডের তৈরি করা পরিকল্পনাই গ্রহণ করেছে ইসরায়েল। কে এই এইল্যান্ড? তিনি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাবেক প্রধান। অবসর নেওয়ার পর জাতীয় নিরাপত্তা অধ্যয়ন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক ছিলেন। এইল্যান্ডের পরিকল্পনার মূল কথা আলোচনা সমাধান নয়। উত্তর গাজার চার লাখ বাসিন্দাকে দুটি বিকল্প দিতে হবে—হয় অনাহারে মরো অথবা জায়গা ছেড়ে পালাও। এটাই ইসরায়েলের যুদ্ধে লক্ষ্য অর্জনের একমাত্র উপায়।
এই পরিকল্পনা ইসরায়েলি সেনাবাহিনী, সংসদ এবং সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি এইল্যান্ডের পরিকল্পনা গভীরভাবে অধ্যয়ন করছেন। নিজের প্রধান সহকারী রন ডারমারকে গত ডিসেম্বরে বলেছেন ‘গাজা সাফ’ করার উপায় খুঁজে বের করতে। সে অনুযায়ী কাজ এগোচ্ছে। গাজার মধ্য দিয়ে একটা করিডর তৈরি করেছে ইসরায়েল। সেখানে সৈন্যদের বিপুলসংখ্যায় মোতায়েন করা হয়েছে। এর ফলে এখন গাজার উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়া কার্যত বন্ধ হয়ে গেল ফিলিস্তিনিদের।
এরই মধ্যে নির্বিচার হত্যাকাণ্ডও চলছে। অবিরাম গোলাগুলি, তাঁবুতে দুই হাজার পাউন্ডের বোমা ফেলা তো চলছেই। সঙ্গে হাজির হয়েছে ইসরায়েলিদের সর্বশেষতম কিলিং মেশিন—বিস্ফোরণকারী রোবট। এই রোবট একসঙ্গে পরপর ছয়টি বাড়ি ধ্বংস করতে সক্ষম। এই নরকে কিছুদিন বাস করেছেন একজন সাংবাদিক। তিনি মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন, ‘এমন বোমা বিস্ফোরণের অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনো হয়নি। এমন শব্দ আমি আগে কখনো অনুভব করিনি।’
তারপরও জাবালিয়ার লোকেরা তাঁদের বাড়ি থেকে সরে আসছেন না। তাঁরা বলছেন, দক্ষিণে মারা যাওয়ার চেয়ে গাজা শহরে থেকে মরা ভালো। মৃত্যু তো মৃত্যুই। কিন্তু দক্ষিণে তাঁবুতে বাস করা জীবন অসহনীয়। উত্তরের তুলনায় অনেক কঠিন। প্রতিদিন চলছে হত্যাকাণ্ড। পুরো পৃথিবী যেন নীরব থেকে একে উত্সাহিত করছে। বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আভি বেরেলি গত অক্টোবরে লিখেছেন যে ফিলিস্তিনিরা ‘এমন একটি সমাজ, যারা মৃত্যুকে উপাসনা করে।’
গণহত্যায় সমর্থনকারী এই অধ্যাপকেরা, নিরস্ত্র মানুষ-নারী-শিশুদের হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধী সমস্ত জেনারেল এবং সৈন্যরা নিরাপদেই থাকেন। এবারও তাঁরা ক্রিসমাসের কেনাকাটার জন্য লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে যাবেন, ওয়েস্টএন্ডে কেনাকাটা করবেন। তাঁদের কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় থাকবে না। আন্তর্জাতিক আদালতগুলো তাঁদের কিছু করতে অক্ষম।
সংবাদমাধ্যম হয় নীরব অথবা নিজেই এসব গণহত্যায় জড়িত। স্কাই নিউজ ইসরায়েলি এক সেনাঘাঁটিতে হিজবুল্লাহর রকেট হামলায় নিহত সৈন্যদের বলছে ‘কিশোর হত্যাকাণ্ড’। আর ইসরায়েলিদের এক স্কুলে চালানো বোমা হামলায় নিহত ২৩টি শিশুর মৃত্যু শুধু উল্লেখিত হয়েছে সংখ্যায়।
একইভাবে বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সম্পাদক জেরেমি বোয়েন সাক্ষাৎকার নেন এইল্যান্ডের। তাঁর ভাবভঙ্গি এমন, যেন কোনো গবেষকের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। যেন এইল্যান্ডের মানুষ মারার পরিকল্পনা এক বৈধ জিনিস। সম্ভবত বোয়েন মনে করেন যে জেনেভা ও গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলো মৃত জিনিস। এইল্যান্ড নিজে যা বলেন, একজন রিপোর্টার হিসেবে বোয়েন তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেননি বা তাঁর দাবি যাচাই করার চেষ্টা করেননি।
বিবিসি ও স্কাই নিউজের মতো সংবাদমাধ্যম থাকে নীরব। শিশু, নারী, বেসামরিক মানুষ হত্যাকারী সশস্ত্র যোদ্ধা এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্যকে তারা অস্পষ্ট করে দেয়। ইসরায়েলের উদ্দেশ্যও তা–ই। নীরবতা সময়ক্ষেপণ করে। আর এই সময় বাড়ায় মৃত্যু।
উত্তর গাজার জন্য ইসরায়েলের পরিকল্পনা সফল হলে দক্ষিণ লেবানন হবে পরবর্তী শিকার। ইসরায়েলের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেইর বেন শাব্বাত বলেছেন, লেবাননে ইসরায়েলের বর্তমান অভিযানের তিনটি বিকল্প ছিল—ইসরায়েলের সামরিক নিয়ন্ত্রণে একটি নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা, একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, যা সীমান্তে ইসরায়েলের পছন্দের শাসক বসাতে দেবে আর পুরো সীমান্ত বরাবর জমি খালি করা।
শাব্বাত নিজে শেষ বিকল্পের পক্ষে। তাঁর মতে, এই বিকল্পের সুবিধা হলো এতে তুলনামূলকভাবে খরচ কম। আর এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে ভিটেমাটিছাড়া হতে হবে। ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোনো জায়গা আক্রমণ করলে ইসরায়েল খোদ নিজে এসে হাজির হবে প্রতিশোধ নিতে। সর্বোপরি, ধর্মীয় জায়নবাদীরা তো দাবি করেনই যে তাঁদের জেরুজালেম বিস্তৃত দামেস্ক পর্যন্ত।
এই পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? আরব বিশ্বের প্রতিটি মানুষের একটি স্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। আজ যাঁরা যুদ্ধ দেখছেন পাশে দাঁড়িয়ে, কাল তাঁরাও বাধ্য হবেন যুদ্ধে নামতে। ইসরায়েল তাঁর সীমানা বাড়িয়েই যাচ্ছে। এই হুমকি সেখানকার প্রতিটি দেশকে জড়িয়ে ফেলবে। জর্ডান একসময় ইসরায়েলের সঙ্গে তার শান্তি চুক্তি ছিন্ন করবে। ইরান ও হিজবুল্লাহ লড়বে জীবনের জন্য।
২০০১ সালে তালেবানের পতন ঘটাতে আমেরিকানদের কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল। আর আমেরিকানদের তাড়াতে তালেবানের লেগেছিল ২০ বছর। ২০০৩ সালের এপ্রিলে বাগদাদে সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি নামাতে আমেরিকানদের লেগেছিল তিন সপ্তাহ। ইরাকে আমেরিকানদের যুদ্ধ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হতে লেগেছিল আরও আট বছর সময়।
আর যে যুদ্ধের কথা আমরা বলছি, তা কোনো শাসক হটানোর যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধে সিরিয়া, জর্ডান, ইরাক ও ইরানের সুন্নি ও শিয়াদের আত্মপরিচয় জড়িয়ে যাবে। এই যুদ্ধ হবে তাদের প্রত্যেকের জন্য নিজের অস্তিত্বের লড়াই।
আপনার মতামত জানানঃ