৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় দেশজুড়ে বেশ কিছু হতাহত ও সম্পদহানির ঘটনা ঘটেছে। অপরাধ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা ও দৃশ্যমান প্রতিকারের অভাবেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকার শক্ত অবস্থান না নিলে এ ধরনের ঘটনা বাড়তে পারে। সর্বশেষ গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এবং সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) গণপিটুনিতে দুজনের মৃত্যুর ঘটনায় একই সঙ্গে উদ্বেগ ও নিন্দার ঝড় উঠেছে।
ঢাবির ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে দুই দফায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়। প্রায় একইভাবে জাবির একদল শিক্ষার্থীর দফায় দফায় মারধরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা প্রাণ হারান। বুধবার ভোরেই বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় গ্রামবাসী পিটিয়ে মেরেছে এক সন্দেহভাজন গরুচোরকে। চুরির কাজে ব্যবহৃত সন্দেহ করে একটি পিকআপও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনাগুলোকে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখছেন পর্যবেক্ষকেরা।
বিশেষ করে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। প্রতিবাদমুখর হয়েছে সংস্কার ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে সদ্য গঠিত সংগঠনগুলো। কোটাবিরোধী ও হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারীরা এ ধরনের ঘটনার নিন্দা করে নির্যাতনকারী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রেক্ষাপট ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আন্দোলন দমনে পুলিশের ভূমিকার কারণে বিক্ষুব্ধ জনতা দেশজুড়ে থানাগুলোতে হামলা চালায়। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যু ঘটে। নিরাপত্তাহীনতার কারণ দেখিয়ে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা বেশ কয়েক দিন কাজ থেকে বিরত থাকেন। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর সরকারের বারবার আহ্বানের পর ধীরে ধীরে পুলিশ কাজে ফেরে। কিন্তু অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি এবং যানবাহনের ঘাটতিসহ নানা কারণে পুলিশ এখনো পূর্ণশক্তিতে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর এর প্রভাব পড়ছে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বেশ কয়েক দিন ধরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ও সম্পত্তিতে হামলা চলে। নেতা-কর্মীদের বড় অংশ আত্মগোপনে চলে গেলেও অনেকে হতাহত হন। পর্যবেক্ষকদের মতে, দেড় দশকের স্বৈরশাসনে আওয়ামী লীগের প্রতি সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশের মনে যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এসব হামলায়।
ঢাবির সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক এ বিষয়ে আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই ধরনের হত্যাকাণ্ড আর মব জাস্টিস কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে শক্ত অবস্থান না নিতে পারলে এই ভয়াবহতা বাড়তে থাকবে। তখন পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
বিচার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার নানা ধরন সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাঙ্গন, সরকারি অফিস, এমনকি আদালত প্রাঙ্গণেও হামলা, নির্যাতন বা লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পেটানোর ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষকসহ অনেককে জোর করে তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণ ও ভবনে আসামিদের ওপর চড়াও হওয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে বিশেষ ক্ষেত্রে ভোরবেলা বিচারিক কার্যক্রমের কথা পর্যন্ত বিবেচনা করা হয়।
৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পঙ্গু আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে। আট বছর আগে আরেক হামলায় তিনি একটি পা হারান। ৫ আগস্ট ছাত্রদের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে রাস্তায় পেয়ে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার মাত্র কয়েক দিন আগেই বাবা হয়েছিলেন মাসুদ।
৮ সেপ্টেম্বর বগুড়ায় আদালত চত্বরে লাঞ্ছিত হন ইউটিউব তারকা আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ এনে কয়েকজন যুবক এই হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন হিরো আলম।
গত বুধবার ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কুড়িল টোল প্লাজায় নিয়ম ভেঙে বেশ কয়েকজন দাঁড়ানো যাত্রীসহ ঢুকে পড়ে একটি পিকআপ। টোল প্লাজার কর্মীরা বিষয়টি উল্লেখ করে প্রবেশে বাধা দিলে পিকআপের যাত্রীরা তাঁদের ওপর চড়াও হন। এ ঘটনার ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ট্রাকের কয়েকজন লোক একপর্যায়ে ব্যারিকেড দণ্ডটি ভেঙে গাড়ি নিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে চলে যান। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগও করেনি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দুঃখ প্রকাশ দুটি ক্যাম্পাসে গণপিটুনিতে দুজনের মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষিত। তা ছাড়া আইন কারও হাতে নেওয়ার অধিকার নেই। সবাইকে সচেতন হওয়া দরকার।
‘মব জাস্টিস’ বা উত্তেজিত জনতার হাতে বিচারের তীব্র সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। তাঁরা দুজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিচার নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন। তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্যাতনকারী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অতি দ্রুত আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিলে উত্তেজিত মবকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। মব জাস্টিস গ্রহণযোগ্য নয় এবং কোনো সমাধানও আনবে না।
সমন্বয়ক সারজিস আলম তাঁর স্ট্যাটাসে বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন হোক, চোর হোক অথবা দাগি আসামি হোক, কাউকে এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার বা সাহস কোনো একজন ব্যক্তি কীভাবে পান? …আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ তৈরি হওয়া প্রয়োজন।
সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘মব জাস্টিস কোনো বিচার নয়। এটি শুধু আরও সহিংসতা ও অন্যায়ের কারণ হয়। আমরা ন্যায়বিচার চাই, সহিংসতা নয়।’
সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ পুরোদমে কাজ করছে। একটা সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটু সময় লাগে। আশা করি খুব দ্রুতই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শতভাগ স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’
আপনার মতামত জানানঃ