বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ছাত্র আন্দোলনের শক্তি উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে শুধু নয়াদিল্লির কূটনীতির অক্ষমতা নয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশের রাজপথে ছাত্রদের আন্দোলনের মেজাজ মাপতেও ব্যর্থ হয়েছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এর প্রেক্ষিতে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে ভারতকে এখন কৌশলগতভাবে ধৈর্যের বহুবিধ পরীক্ষা দিতে হবে। অনলাইন আউটলুক ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের সাউথ ব্লকে বর্তমানে ক্ষমতার করিডোরে খুব বেশি গুঞ্জন শোনা যাবে একটি কথা- ‘স্ট্র্যাটেজিক প্যাশেন্স’ বা কৌশলগত ধৈর্য। ২০১৫ সালে প্রথম এই টার্মটি ব্যবহার করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ভারতের দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের অস্থিরতা বর্ণনার জন্য এটা একটা যোগ্য বাক্যাংশ।
২০১৪ সালে আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণিকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিল ভারত। সেই আফগানিস্তান, ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় জনতার বিদ্রোহ, মালদ্বীপে ‘ইন্ডিয়া আউট আন্দোলন, নেপালে ঘন ঘন নেতৃত্বের পরিবর্তনের ফলে এসব দেশকে হয়তো ভারত না হয় চীনের মুখাপেক্ষী করে ফেলেছে। পুরো অঞ্চল তা দেখেছে।
নির্মমতা ঘটেছে বাংলাদেশে। এখানে ভারতের সবচেয়ে কাছের বন্ধু এবং মিত্র শেখ হাসিনাকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে। যে উত্তাল পরিস্থিতি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে অথবা ছাত্রদের আন্দোলনের যে শক্তি তা আগেভাগে অনুমান করতে অক্ষমতা দেখিয়েছে নয়াদিল্লি। এটা শুধু ভারতের কূটনীতির দুঃখজনক পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটায় এমন না।
রাজপথের ভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাও। ভারত আত্মতুষ্টিতে হয়তো ভুগছিল এবং বিশ্বাস করেছিল যে, শেখ হাসিনা শক্তি খাটিয়ে অতীতের মতো সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন। শেখ হাসিনা ক্রমশ তার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। এর যেকোনো লক্ষণ দেখা যায়নি, বিষয়টি এমন নয়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত অনীল ওয়াধা বলেন, গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রমশ শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণ এবং আওয়ামী লীগের দুর্বলতা বাকি বিশ্বের মতো ভারতও দেখেছে। তা সত্ত্বেও চীনকে মোকাবিলা এবং ইসলামপন্থিদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তারা তাকে (শেখ হাসিনা) সমর্থন দেয়ার পথ বেছে নেয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকার কারণে ভারতের সঙ্গে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সবসময়ই চমৎকার সম্পর্ক বিদ্যমান। গান্ধী পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কের সমীকরণ সবার জানা।
কিন্তু তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধন তৈরি করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। বাংলাদেশি কথিত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এবং ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণার সময় আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য বা প্রতিবাদ প্রকাশ্যে জানাননি হাসিনা। যখন আসামে নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) আপডেট করা হলো এবং বলা হলো অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে- তখনও তিনি ভারত সরকারের ওপর আস্থা রাখাকেই বেছে নেন। বাংলাদেশের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নিশ্চিত করেন যে, এনআরসি তাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। এতে বাংলাদেশ বা ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না।
২০০৯ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। তারপর তিনি উলফার যেসব নেতা বাংলাদেশে ছিলেন তাদের ভারতের হাতে তুলে দেন। এর মধ্যদিয়ে ভারতের নিরাপত্তার প্রতি তার সংবেদনশীলতার কারণে ভারতের সরকার এবং বিরোধীদের কাছে যথেষ্ট প্রশংসা পান তিনি।
কূটনৈতিকভাবে শেখ হাসিনার ‘রাজনৈতিক মৃত্যু’ হলো ভারতে মোদি সরকারের জন্য একটি বড় আঘাত। ক্ষমতায় থাকা গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার পেছনে পুরোটা সময়, শক্তি এবং সম্পদ (রিসোর্সেস) ব্যয় করার পর এখন (বাংলাদেশে) অনুসরণ করার মতো কোনো নেতা নেই।
নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন দায়িত্বে। এতে নয়াদিল্লি কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারে। আন্তর্জাতিক মর্যাদা আছে ড. ইউনূসের। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে আছে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তিনি এরই মধ্যে যথার্থ বার্তা দিয়েছেন। সংখ্যালঘুদের সুরক্ষিত রাখা ও আইনশৃঙ্খলা ফেরানোর নিশ্চয়তা দিয়েছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের আতঙ্কিতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়েছেন। পরিস্থিতি এখনো ঘোলাটে থাকায় ড. ইউনূস এসব কাজ করতে সক্ষম হবেন কিনা তা নিয়ে নয়াদিল্লি এখনো নার্ভাস।
ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মধ্যে কখনোই সম্পর্ক বন্ধুর ছিল না। এর প্রেক্ষাপট স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। গত কয়েকটি বছর গণতান্ত্রিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকার পশ্চাৎপদ হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ বছর জানুয়ারিতে বিতর্কিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীদের দাবি করা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে সমর্থন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ নিয়ে বিপরীত অবস্থানে থাকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। নয়াদিল্লি শেখ হাসিনার জন্য লড়াই অব্যাহত রাখে। তবে এই বিরোধ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে ক্ষতি করতে পারেনি। নির্বাচনের পর হাসিনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, নয়াদিল্লির অনুরোধে তারা সুর নরম করেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে এত উদ্বিগ্ন নয় ভারত, কিন্তু যখনই হোক নির্বাচনের ফলের দিকে দৃষ্টি রাখবে ভারত। অনীল ওয়াধা বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি ও তার মিত্রদেরকে ভারত দেখে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের প্রভাবের অধীনে, যারা ভারতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে এখন একটি ভয়ঙ্কর কূটনেতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি নয়াদিল্লি। সম্পর্কটি নিকট ভবিষ্যতে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। উপরন্তু জামায়াতে ইসলামী অব্যাহতভাবে ভারতের জন্য উদ্বেগের। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে অদম্য সমর্থন দেয় ভারত। এতে যে তিক্ততা ও ক্ষোভ রয়েছে তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত খুব সহজ হবে না।
এ অঞ্চলের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন সাবেক কূটনীতিক রাজীব ভাটিয়া। তিনি বলেন, এটা করতে হবে ধীরে ধীরে স্টেপ বাই স্টেপ। পার্লামেন্টে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে ঢাকায় অসন্তোষ আছে। প্রকৃতপক্ষে জয়শঙ্কর তার বক্তব্যে পুলিশের হাতে নিহত বিপুল সংখ্যক প্রতিবাদকারীর কথা উল্লেখ করেননি। ফলে শেখ হাসিনার কূটনৈতিক মৃত্যু মোদি সরকারের জন্য বড় আঘাত।
কিন্তু ড. ইউনূস তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উচ্চ পর্যায়ের ফোনকল করেছেন। তিনি মোদিকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, তার সরকার বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দু ও অন্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবে। এতে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করতে প্রস্তুত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। ১৭ই আগস্ট ভারতের আয়োজনে গ্লোবাল সাউথ সামিটেও যোগ দিয়েছেন ড. ইউনূস। ভারতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। প্রতিবাদ বিক্ষোভকালে নিহতদের একজনের পিতা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ফলে শেখ হাসিনাকে এখন ফেরত চাইতে পারে ঢাকা। যদি এমন হয়, তাহলে নতুন এক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে নয়াদিল্লি।
এই অঞ্চলে ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজনকে যদি হস্তান্তর করা হয় তাহলে বাকি প্রতিবেশীদের কাছে একটি ভয়ানক বার্তা যাবে। তা হলো তারা ভারতকে একটি অবিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে চিহ্নিত করবে। এ প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। ফলে যত তাড়াতাড়ি শেখ হাসিনা বাইরে চলে যান এবং অন্য একটি দেশে আশ্রয় নেবেন ততই ভালো।
অন্যদিকে অতীতের সম্পর্ক ভেঙে ঢাকায় ক্ষমতার সঙ্গে নতুন করে কাজ শুরু করা ভারতের জন্য এক চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে নয়াদিল্লি একটি বার্তা পাঠাবে। তা হবে, তারা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে আছে। সরকারের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক হবে। হাসিনা আমলে যা ছিল, তা কাজে আসবে না। এটা হবে জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক। সেটাই চূড়ান্তভাবে সম্পর্ককে নির্ধারণ করবে। বিশেষ করে এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে।
আপনার মতামত জানানঃ