স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের (এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন) কথা রয়েছে ২০২৬ সালের নভেম্বরে। এ উত্তরণ প্রক্রিয়া শেষে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রফতানিতে শুল্ক পরিশোধের চাপ বাড়বে রফতানিকারকদের। বিশেষ করে সম্ভাবনাময় প্রধান বাজারগুলোয় বেশ উচ্চহারে শুল্ক পরিশোধ করে পণ্য রফতানি করতে হবে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক হিসাব অনুযায়ী, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে শুল্ক পরিশোধ করতে হবে প্রতিবেশী ভারতে।
বাংলাদেশের পণ্য রফতানির প্রধান গন্তব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে কানাডা, ইইউ, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত ও জাপান। বর্তমানে এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে এসব দেশে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছেন বাংলাদেশের রফতানিকারকরা। এডিবির গত মাসে প্রকাশিত এক পলিসি ব্রিফের তথ্য অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের শুল্ক দিতে হবে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। আর প্রতিবেশী ভারতে এ হার হবে ২২ দশমিক ৭ শতাংশ।
‘এক্সপান্ডিং অ্যান্ড ডাইভার্সিফায়িং এক্সপোর্টস ইন বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড দি ওয়ে ফরোয়ার্ড’ শিরোনামে এডিবির এ পলিসি ব্রিফ প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, উত্তরণ-পরবর্তীকালে রফতানিকারকদের কানাডায় শুল্ক পরিশোধ করতে হবে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ হারে। চীনের ক্ষেত্রে এ হার হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। জাপানে পরিশোধ করতে হবে ৯ শতাংশ।
যুক্তরাজ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল থাকলেও দেশটিতে পণ্য রফতানিতে রুলস অব অরিজিনের (আরওও বা রফতানি পণ্যের কাঁচামালের উৎস সংক্রান্ত বিধি) প্রয়োগ আরো কঠোর হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে পণ্য রফতানিতে শুল্ক হার বেশি হলেও পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের তা সবচেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হবে ইইউর বাজারে। এজন্য ইইউসহ বৃহৎ বাজারগুলো থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায় করার বিষয়ে নজর দিতে হবে বেশি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) মোট পণ্য রফতানি হয়েছে ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের। এ বাবদ পাওয়া অর্থের ৫৫ শতাংশের বেশি এসেছে ইইউ ও যুক্তরাজ্য থেকে। আর ভারতে বাংলাদেশের বাজারের ব্যাপ্তি ২ বিলিয়ন ডলারের।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভারতে আমাদের রফতানি হয় ২ বিলিয়ন ডলারের। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর আমাদের সেখানে ২২ শতাংশ হারে শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। ইইউর বাজারে দিতে হবে সাড়ে ১১ শতাংশ। কিন্তু সেখানে আমাদের রফতানি অনেক বেশি।
পুরোটা হিসাব করলে এখন আমাদের ইইউর বাজারেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এখন আমি যদি বিভিন্ন ধরনের মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে (এফটিএ) যেতে চাই, সেক্ষেত্রে আবার আমদানি থেকে পাওয়া রাজস্ব আয়কেও হিসাবে নিতে হবে। কারণ ভারত থেকে আমরা আমদানি করি প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের। চীন থেকে আমদানি করি ২৫-২৬ বিলিয়ন ডলারের।
এগুলো থেকে আমরা শুল্ক বাবদ আয় করি ৪-৫ বিলিয়ন ডলার। এখন তাদের সঙ্গে এফটিএ করতে হলে আমাদেরও বড় অংকের শুল্কছাড় দিতে হবে। সেসব বিষয়ও হিসাবে রাখতে হবে। এখন আমরা হয়তো শুল্কছাড় দিতে পারব একটু ধীরে, কিন্তু তাদের বাজারে তো আমাকে দ্রুত প্রবেশ করতে হবে। এজন্যই এফটিএ বা সিইপিএ (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট) করা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্যদিক থেকে বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ, উৎপাদন ও কর্মীর দক্ষতা বাড়ানোর মতো বিষয়গুলোও জরুরি হয়ে দাঁড়াবে।’
সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে, শুল্ক ও রফতানি নিয়ে কাজ করার জন্য সাতটি উচ্চ পর্যায়ের দল গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি বিভিন্ন ধরনের শুল্ক নিয়ে কাজ করবে। এজন্য কোন দেশে কোন পণ্যে কত শতাংশ হারে শুল্ক বাড়বে তা নিয়ে বিস্তারিত হিসাব করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ শুল্ক বাধা মোকাবেলায় উদ্যোগ নেয়া হলে তা বাস্তবায়নের ওপরেও জোর দিতে হবে। শুল্কমুক্ত সুবিধা না পেলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ বা সিইপিএর মতো চুক্তিতে যেতে হবে। এক্ষেত্রে আরো আগ্রাসী ভূমিকা রাখতে হবে। ২০২৬ সাল বেশি দূরে নেই। আর এক্ষেত্রে জটিলতা হলো দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও ছাড় দিতে হবে।
এছাড়া আগামীতে কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলোও অনেক কঠিন হবে। রুলস অব অরিজিন বা শ্রম মান নিয়েও অনেক কাজ করতে হবে। উন্নত দেশগুলো শুল্ক সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে এতদিন এগুলো সেভাবে আমলে না নিলেও এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এগুলোয় জোর দেবে বেশি। এক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মকানুনের পাশাপাশি কিছু দেশ নিজস্ব নীতিমালাও প্রয়োগ করবে। সেক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণ, শ্রম অধিকার, সুশাসনের মতো বিষয়গুলো আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
আবুধাবিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডব্লিউটিওর মিনিস্টারিয়াল কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলোর সঙ্গে উন্নত দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা চালু রাখতে পারবে। এক্ষেত্রে ইইউর মতো জোটগুলো এখন পর্যন্ত এ সুবিধা অব্যাহত রাখার মতো নমনীয়তা দেখিয়েছে। যদিও জাপান, ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোয় তা দেখা যাচ্ছে না।
দেশগুলোর মধ্যে জাপানের সঙ্গে এখন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া ভারত ও চীনের সঙ্গে এ নিয়ে যৌথ সমীক্ষা হয়েছে। এখন আলোচনা শুরু হবে। এছাড়া সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে পিটিএর আলোচনা চলমান রয়েছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গেও আলোচনা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিদায়ী সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অনেক দেশ আছে যেগুলো থেকে ২০২৬-এর পর আরো তিন বছর শুল্ক সুবিধা পাব। এ নিয়ে আলোচনা চলমান আছে। তবে প্রধান একক বাজার যুক্তরাষ্ট্র এমনিতেই শুল্ক সুবিধা দেয় না। এছাড়া অন্যান্য প্রধান বাজার যেমন জাপান, ভারত, চীনে শুল্ক সুবিধা পাব না।
এ ধরনের দেশগুলোর সঙ্গে আমরা এরই মধ্যে এফটিএ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি। জাপানের সঙ্গেও এখন আলোচনা হচ্ছে। এরপর ভারত, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও হবে। দেশগুলোর সঙ্গে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে আলোচনা শেষ করে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। তাহলে বাজার প্রবেশাধিকারও বজায় থাকবে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো দেশগুলো আরো তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার এমনকি প্রয়োজনে এ-সংক্রান্ত আইনি পরিবর্তনেরও মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এ সিদ্ধান্তটিকে ঘিরেই এখন আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছি। যেসব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আলোচনা শুরু হয়েছে, চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সেই দেশগুলোকে বলা যাচ্ছে যে যতদিন চুক্তি না হয় ততদিন তোমরা শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখবা। এভাবে গ্র্যাজুয়েশনের পর যে শুল্ক আরোপ হওয়ার কথা, দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হলে সেই শুল্ক আরোপ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোয় পণ্য প্রবেশে এলডিসি-বহির্ভূত দেশগুলোর জন্য যে শুল্ক হার নির্ধারণ আছে, তা কোনো নির্দিষ্ট দেশকে লক্ষ্য করে নির্ধারণ করা না বরং নিজস্ব শিল্প সুরক্ষা দিতে সব দেশের জন্য নির্ধারণ করা। সে হার সব দেশের জন্য সমান, কিন্তু যাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি আছে তাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন শুল্ক কাঠামো নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে প্রস্তুতির বিষয়ে এক কথায় যদি বলতে হয় তাহলে বলব প্রস্তুতি নেই। দেশভিত্তিক কোনো পর্যালোচনা খুব একটা নেই। শুধু ইইউর সঙ্গে আলোচনা আছে, কিন্তু তা হচ্ছে মূলত সেখানে কীভাবে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া যাবে সে বিষয়ে। এ বিষয়ে কিছু কাজ হচ্ছে। বাকি দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের কিছুই হচ্ছে না। এফটিএ বা পিটিএর উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ আমরা দেখছি না। কমপ্লায়েন্স প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বড় কোনো ঘাটতি রফতানিকারকদের থাকবে না। কিন্তু বাণিজ্য চুক্তি না থাকলে উচ্চ হারে শুল্ক সুবিধা দিয়ে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ধরে রাখা নিয়ে মারাত্মক সংশয় রয়েছে।’
বিজিএমইএর একদল প্রতিনিধি গতকাল বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। সেখানেও এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে বিজিএমইএ সভাপতি এসএম মান্নান কচি রফতানি বাণিজ্যে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সম্ভাব্য প্রভাব এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রধান রফতানি বাজারগুলোয় শুল্কমুক্ত সুবিধাগুলো অব্যাহত রাখতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা কামনা করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি এসএম মান্নান কচি বলেন, ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী প্রতিবন্ধকতাগুলো নিয়ে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কাজ করছি। এর অংশ হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করেছি। আমাদের এখন দেশভিত্তিক প্রতিবন্ধকতা পর্যালোচনা করে উদ্যোগ নেয়ার সময় এসেছে, যার ধারাবাহিকতায় বিদ্যমান বাজারগুলোয় সুবিধা অব্যাহত রাখাসহ নতুন বাজারগুলোর সম্ভাবনা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি।’
আপনার মতামত জানানঃ