বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং বুয়েটের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি অবস্থান ও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে ঘিরে রোববার ক্যাম্পাসে রীতিমত থমথমে অবস্থা দেখা গেছে।
কথিত আছে, ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের অবস্থাটাও এমন। ২০০২ সালে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে সাবেকুন নাহার সনি নিহত হওয়ার ঘটনায় বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি দানা বেঁধেছিল।
২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের মুখে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয় প্রতিষ্ঠানটিতে। কিন্তু এ ঘটনার ৪ বছর না পেরোতেই বুয়েটে আবারও ছাত্ররাজনীতি চালুর জন্য তৎপরতা শুরু করেছে ছাত্রলীগ। এতে সায় আছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগেরও। বুয়েটের উপাচার্যও বলেছেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চাইলে আবারও ছাত্ররাজনীতি চালু করা যেতে পারে।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক শুরু হয় গত ২৭ মার্চ রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশকে কেন্দ্র করে। এ ঘটনায় পরদিনই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে রাজনীতির বীজ বপনের চেষ্টা হচ্ছে, এমন অভিযোগ এনে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শত শত শিক্ষার্থী। শুক্রবার থেকে তাঁরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে ছয় দফা দাবি জানান।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ছয় সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটিও গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এদিকে ছাত্ররাজনীতি ঠেকাতে বুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে পাল্টা কর্মসূচি পালন করেছে ছাত্রলীগ। দেশসেরা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনতে গতকাল রোববার দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ পালন করে তারা। সমাবেশে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘নিষিদ্ধ হিযবুত তাহ্রীর, জেএমবি ও ছাত্রশিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা বুয়েটে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাই বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত একটি নাটক।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ এখানে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। বুয়েটের এই সিদ্ধান্ত মৌলিক অধিকারপরিপন্থী, সংবিধানপরিপন্থী, শিক্ষাবিরোধী সিদ্ধান্ত।’
সমাবেশ করার পর বেলা আড়াইটায় প্রকাশ্যেই কয়েক শ নেতা-কর্মী নিয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান। এ সময় তাঁরা বুয়েট শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেন। ফুল দেওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে বুয়েট ত্যাগ করেন তাঁরা।
ছাত্রলীগের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও। গতকাল এক কর্মসূচিতে তিনি বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার নামে বুয়েটকে জঙ্গিবাদ, অপরাজনীতি কারখানায় পরিণত করা হচ্ছে কি না খতিয়ে দেখা হবে। সেই রকম হলে সরকারকে অ্যাকশনে যেতে হবে।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘আজকে আমি রাজনীতি করি, সেখানে বুয়েটে যেতে পারব না? এটা কোন ধরনের আইন? এটা কোন ধরনের নীতি?’
ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতার ইঙ্গিত ও তাঁদের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের এ ধরনের বক্তব্যের পর ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অনেকটা নমনীয় সুরে কথা বলেছেন বুয়েট উপাচার্য ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার। গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চাইলে ক্যাম্পাসে আবারও ছাত্ররাজনীতি চালু করা যেতে পারে। পূর্বে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যদি বুয়েটে রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তবে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হলে তাঁদেরই আবার উদ্যোগী হতে হবে। এ জন্য রাজনীতি শিখতে হবে। তাঁরা যদি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন, তখন হয়তো রাজনীতি চালু হতে পারে।’
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যা বলছেন
আন্দোলনরত বুয়েট শিক্ষার্থীরা জানান, তাঁরা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চান না। তাঁদের যুক্তি, ছাত্ররাজনীতি সহিংসতা ছড়ায়। বছর তিনেক আগে তড়িৎকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড তুলে ধরেন তাঁরা। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার বিক্ষোভ সমাবেশে উঁচিয়ে ধরা প্ল্যাকার্ডেও বিষয়টি উঠে এসেছে। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল—‘আমার ভাইয়ের রক্ত এখনো শুকায়নি’, ‘আর কত প্রাণ চাই’, ‘আবরার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’সহ নানা স্লোগান।
গতকাল সকাল ৮টা থেকে পূর্বঘোষিত আন্দোলন কর্মসূচি পালনের কথা থাকলেও ক্যাম্পাসে দেখা মেলেনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের। গতকালের পরীক্ষা বর্জন করেছেন তাঁরা। বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাস রাজনীতি ও অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত থাকা এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে আমরা সকল ব্যাচের শিক্ষার্থীরা অনতিবিলম্বে আমাদের একাডেমিক কার্যক্রমে ফেরত যাব। ইতিমধ্যে আমরা আমাদের পরীক্ষাগুলো রিশিডিউল করার আবেদন জানিয়েছি।’
ছাত্ররাজনীতি ছাড়াই বুয়েট শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বগুণের বিকাশ ঘটছে জানিয়ে তাঁরা বলেন, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বরাবরই একটি নিরাপদ এবং মুক্ত ক্যাম্পাস চেয়ে এসেছেন, যেখানে ক্ষমতাচর্চার লোভ-লালসার শিকলে জিম্মি হয়ে যাবে না তাঁদের নিরাপত্তা ও শিক্ষাঙ্গনের উপযুক্ত পরিবেশ।
বুয়েটে মৌলবাদী সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে ছাত্রলীগের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, বর্তমানে হিযবুত তাহ্রীর নিয়ে কথা উঠেছে। এটি কোনো রাজনৈতিক দল না বরং নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন। এদের কর্মকাণ্ড তাঁরা ক্যাম্পাসে দেখতে পান বহিরাগতদের (সিসি ফুটেজ অনুযায়ী) লাগানো বিভিন্ন পোস্টার, মেইল বা প্রচারপত্র ইত্যাদির ভিত্তিতে। শিক্ষার্থীরা বলেন, তাঁরাও হিযবুত তাহ্রীরের কার্যক্রমের বিপক্ষে এবং এ-জাতীয় অপশক্তির উত্থান যেন বুয়েটে না হয় সে জন্য তাঁরাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আপনার মতামত জানানঃ