ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে সংঘাতের পর থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত আট দিনে সারা দেশে দলটির অন্তত ৭ হাজার ৮৩৫ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দলের মহাসচিবসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতা রয়েছেন অন্তত সাতজন। সাবেক সংসদ সদস্যসহ জেলা ও মহানগর পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা রয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে পুলিশের ব্যাপক অভিযান শুরুর পর বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতার বেশির ভাগই আত্মগোপনে রয়েছেন।
সর্বশেষ গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ফেনীর পরশুরামের সাবেক পৌর মেয়র আবু তালেবকে আটক করা হয়েছে বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে রাতে পর্যন্ত পুলিশ আটকের কথা স্বীকার করেনি।
গত শুক্রবার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরের তিন জেলায় মোট ১১২ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে ঢাকার আদালত ও প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে জানা গেছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ৭০ জন এবং নারায়ণগঞ্জে ৩৯ জন, ফেনীতে ১ জন ও জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গত আট দিনে ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় ২ হাজার ২৩৯ নেতা-কর্মী। সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায়। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সংঘর্ষ, পুলিশ হত্যা, পুলিশের অস্ত্র লুট, হরতাল ও অবরোধে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় করা মামলায় বেশির ভাগ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বিএনপি ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশে গত অক্টোবর মাসে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গত মাসে দেশটির বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন বাড়িয়েছে সরকার। এ ছাড়া অর্থনৈতিক টানাপোড়েনও অব্যাহত ছিল। রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতেও সংঘাত চলেছে।
বেলজিয়ামের ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। অক্টোবরের পরিস্থিতি নিয়ে আইসিজির ওয়েবসাইটে সম্প্রতি ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
সংস্থাটি প্রতি মাসেই এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গত জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ‘অপরিবর্তিত’ থাকলেও অক্টোবরে অবনতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এবারের প্রতিবেদনে অবনতিশীল পরিস্থিতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও রয়েছে গুয়াতেমালা, মিয়ানমার, তুরস্ক, মোজাম্বিক, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, সুদান, ফিলিস্তিন, ইসরায়েল, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেন। অপর দিকে আগের তুলনায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলায়।
আইসিজি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংঘাত প্রতিরোধ এবং সমাধান দিতে বিশ্লেষণ ও পরামর্শ দিয়ে থাকে। এ লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে গবেষণা, বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কাজ করে থাকে সংস্থাটি।
আইসিজি বলেছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধী দল বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন বাড়িয়েছে সরকার। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় সমাবেশের আয়োজন করে বিএনপি। ওই সমাবেশ ঘিরে দলটির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মূলত পুলিশের সংঘর্ষ হয়।
এদিন দেশের অন্যান্য বড় শহরেও সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। এতে এক পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন। আহত হন অনেকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীতে সংঘর্ষের পর দিন ২৯ অক্টোবর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির প্রায় ১০০ নেতা-কর্মীকে আটক করে পুলিশ।
বিএনপির দাবি, ২১ থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত দলটির প্রায় তিন হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৯ অক্টোবর সারা দেশে হরতাল ডাকে বিএনপিসহ বিরোধীরা। এরপর ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত দেশব্যাপী অবরোধ জারি করা হয়। এতে সংঘাতের আশঙ্কা বাড়ে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে আইসিজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮ অক্টোবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের নিচে নেমেছে।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে সংঘাত চলমান রয়েছে বলে জানানো হয়েছে আইসিজির প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, ২ অক্টোবর সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) এক নেতাকে আটক করে র্যাব-২। পরে ৪ অক্টোবর এক বন্দুকযুদ্ধে আরসার এক সদস্য নিহত হন।
৯ অক্টোবর সশস্ত্র গোষ্ঠী রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের সন্দেহভাজন সদস্যরা আরসার দুই সদস্যকে হত্যা করেন। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে মাদক চোরাচালান ও হত্যার অভিযোগে গত মাসে কক্সবাজারে গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটেছে।
আপনার মতামত জানানঃ