ঘূর্ণিঝড় মোখা এখন অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে বলে বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। একইসাথে এর কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগও বাড়ছে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো থেকে ৯০০ কিলোমিটারের কম দূরত্বে অবস্থান করতে থাকা এই ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে।
ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে বাংলাদেশের সকল উপকূলীয় এলাকা ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের হুমকির সম্মুখীন হতে পারে বলে জানিয়েছেন কানাডার সাসকাচোয়ান ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কামাল পলাশ।
এছাড়াও তিনি বলছেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষদের জীবন হুমকির সম্মুখীন এবং তিনতলার নিচে কোনো ভবনে আশ্রয় নেওয়া নিরাপদ নয়।
মোস্তফা কামাল বলেন, মোখা আজ দুপুর তিনটার সময় ১৪.৩ উত্তর অক্ষাংশ, ৮৮ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থান করছে।
তিনি বলেন, “এটি উত্তর-পূর্ব দিকে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। এটি বাংলাদেশের দিকে আসা শুরু করে দিয়েছে। আজকে সন্ধ্যার পরে এর প্রভাবে চট্টগ্রাম বিভাগ ও কক্সবাজারে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আজকে রাত থেকে জোয়ার এবং ভাটায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব বুঝতে পারবো। সমুদ্র প্রচণ্ড উত্তপ্ত।”
তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ পাওয়া তথ্যচিত্র মতে এ ঘূর্ণিঝড়টি সম্পূর্ণ বাংলাদশের উপর ও মায়ানমারের উপর দিয়ে অতিক্রম করবে।
এদিকে মোখার কবল থেকে বাঁচাতে শুক্রবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ উপকূলীয় এলাকা থেকে কয়েক লাখ মানুষকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা ইউএনবি।
বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান ইউএনবিকে বলেছেন, উপকূলীয় এলাকার মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ৫৭৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তূত রয়েছে। শনিবার থেকে প্রায় ৫ লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রপরিচালিত গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার সংবাদপত্র জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যের পশ্চিম উপকূলে বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, যেখানে দিয়ে ঝড়টি বয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এর আগে জানা গিয়েছিল, আজ (১২ মে) সমুদ্রে ২৮ ফুট উচ্চতার ঢেউ সৃষ্টি করেছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’। আমেরিকার নৌবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত জায়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের সূত্র থেকে এ তথ্য জানা যায়। এ সেন্টার ঘূর্ণিঝড় মোখার সুপার-সাইক্লোনে পরিণত হওয়ার পূর্বাভাস দেয়। যেখানে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ২২১ কিলোমিটারের বেশি থাকবে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, “ঘূর্ণিঝড়টি সেন্টমার্টিনে পুরোপুরি আঘাত হানবে তাই এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আমরা আশঙ্কা করছি সেন্টমার্টিনে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ দ্বীপটি প্রচণ্ড হুমকির সম্মুখীন। এ দ্বীপের মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানাবো।”
তিনি বলেন, কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
এছাড়া নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১০ থেকে ১২ ফুট, বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে ৮ থেকে ১২ ফুট ও খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে ৭ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হওয়ার হুমকির সম্মুখীন।
তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখা যখন সেন্টমার্টিন দ্বীপ অতিক্রম করবে সেই সময় কোনো ভবনের ৩ তলার নিচে আশ্রয় নেওয়া মানুষের জীবন নিরাপদ নয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপটি সম্পূর্ণ সমুদ্রের পানির নিচে থাকার সম্ভাবনা ৯০% এর বেশি।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে জন্ম নেওয়া ঘূর্ণিঝড় মোখা ইতিমধ্যে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর।
শুক্রবার সকালে দেওয়া আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১০ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে মোখার অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার কথা জানানো হয়। আজ সকাল ১০টার দিকে এ বিজ্ঞপ্তি দেয় আবহাওয়া অফিস। সেখানে সকাল ছয়টার সময়ের মোখার গতিপ্রকৃতি তুলে ধরা হয়।
আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও এর কাছাকাছি মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা উত্তর দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে মধ্য বঙ্গোপসাগর ও এর কাছাকাছি দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর এলাকায় অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। এটি দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে।
মোখা কি সিডরের মত সুপার সাইক্লোন হতে পারে?
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ উমর ফারুক জানান যে এটি এখনো অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় অবস্থায় রয়েছে। তবে সিডরের মত সুপার সাইক্লোনে পরিণত হবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
আবহাওয়াবিদ উমর ফারুক বলেন, “সিডর ছিল সুপার সাইক্লোন। মোখা এখনো অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়। যদিও এর কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ বাড়ছে, কিন্তু এটি সুপার সাইক্লোনে পরিণত হতে পারে কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।”
ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ যদি ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটারের মধ্যে থাকে, তাহলে সেটিকে স্বাভাবিক ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ৮৯ থেকে ১১৭ কিলোমিটারের মধ্যে হলে সেটি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আর বাতাসের গতিবেগ ১১৮ থেকে ২২০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে সেটিকে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
আর বাতাসের গতিবেগ যদি ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটারের বেশি হয়ে থাকে তাহলে সেটিকে সুপার সাইক্লোন বলা হয়।
দুই হাজার সাত সালে হওয়া সিডর ছিল সুপার সাইক্লোন। ঐ বছরের নভেম্বরে হওয়া ঐ ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৬০ কিলোমিটার। এর আগে বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার।
আজ সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে জানান যে এটি সুপার সাইক্লোনে পরিণত হবে, সূচক বিশ্লেষণ করে এখনো সেরকম কিছু বলা যাবে না। তবে এটিকে সুপার সাইক্লোনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তিনি।
আজিজুর রহমান বলেন, “এটি সুপার সাইক্লোনে পরিণত হবে বা হবে না, এখনই এটি বলা যাচ্ছে না। এই ঘূর্ণিঝড়টির ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ব্যাস, কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ সবই বাড়ছে। তবে এটি উপকূলের কাছে আসতে এখনও ৪৮ ঘণ্টার মত বাকি। এই সময়ের মধ্যে এটি দুর্বলও হতে পারে।”
গতিপথ
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্তমান গতি প্রকৃতি অনুযায়ী এগোলে বা দিক না পাল্টালে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় মোখা ১৪ই মে বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কিয়াকপিউয়ের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালকও বলেন যে গত ৫০ বছরের ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ঐতিহাসিকভাবে মে মাসের ঘূর্ণিঝড় উত্তর উত্তর-পূর্ব দিকেই ধাবিত হয়েছে।
বিভিন্ন গ্লোবাল মডেল বিশ্লেষণ করে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কামাল পলাশ বলছেন “ঘূর্ণিঝড় মোখার অগ্রভাগ ১৪ ই মে সকাল ৬ টার পর থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলে আঘাত করার আশঙ্কা রয়েছে। ঘুর্ণিঝড় কেন্দ্র দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ও পিছনের অংশ সন্ধ্যা থেকে ১৫ইমে সোমবার ভোর পর্যন্ত উপকূল অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে”। এছাড়া ভূমিধসের আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন এই আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ।
অন্যদিকে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলছেন, এখন যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে যে বাংলাদেশের উপকূলের দিকে আসছে ঘূর্ণিঝড়টি।
“বাংলাদেশে কক্সবাজার অঞ্চলে কিছু প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে এটা টেকনাফের ওপর দিয়ে যাবে মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে যে গতিপথ দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের মূল অংশটা টেকনাফ ছূঁয়ে যাবে। হয়তো টেকনাফের একটু দক্ষিণ দিক অতিক্রম করে মিয়ানমারের দিকে চলে যেতে পারে।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ