‘অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচি’র আওতায় বছরে দুই দফা ৪০ দিন করে কাজের সুযোগ পান গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা। তারা মাটি কাটা, রাস্তা সংস্কার, রাস্তার ঘাস পরিষ্কার, ডোবার কচুরিপানা অপসারণের মতো কাজ করেন। শরীয়তপুর সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) এই ‘অতিদরিদ্রদের’ ১৪ জনের তালিকায় জায়গা পেয়েছেন এক ইউপি সদস্যের ১১ স্বজন। উল্লেখ্য, এই ইউপি চেয়ারম্যান, আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, শরীয়তপুর আওয়ামীলীগের সদস্য।
এমনকি এ বিষয়ে অনুসন্ধানের পর ইউপি চেয়ারম্যানের বক্তব্য জানতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন একদল সাংবাদিক। আজ রোববার দুপুরে সদর উপজেলার আংগারিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে এ হামলার ঘটনা ঘটে। ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য গিয়াস উদ্দিনের ছেলে আলিমুল হক এ হামলা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উপজেলা প্রশাসন ও ইউপি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচির কাজ শুরু হয়েছে। আংগারিয়া ইউনিয়নে ৬৮ শ্রমিকের অনুকূলে ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২ নম্বর ওয়ার্ডের চরচটাং গ্রামে ১৪ শ্রমিক দিয়ে একটি মাটির রাস্তা সংস্কার চলছে। ওই প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য গিয়াস উদ্দিন।
১৪ শ্রমিকের নামের তালিকায় ইউপি সদস্যের স্ত্রী নাছিমা বেগম, ছেলে আলিমুল হক মোল্যা, মেয়ে সোনিয়া বেগম, ছেলের স্ত্রী হালিমা আক্তার, ভাই আবু সিদ্দিক মোল্যা, ছেলের শাশুড়ি-শ্যালিকাসহ ১১ জনের নাম রয়েছে।
তাদের নামের বিকাশ নম্বরে শ্রমিকের মুজরি দেওয়া হচ্ছে। ওই তালিকা দিয়ে গত অর্থবছরে একটি প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, গ্রামের দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ কাজের জন্য শ্রমিকদের প্রতিদিন ৪০০ টাকা মুজরি দেওয়া হয়।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তালিকা প্রস্তুত করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠানো হয়। ওই তালিকা যাচাই-বাছাই শেষ করে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকে ওই শ্রমিকদের বিকাশ নম্বরে কাজের টাকা পরিশোধ করা হয়।
রোববার সকালে চরচটাং গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি মাটির রাস্তা সংস্কার করা হচ্ছে। সেখানে তালিকাভুক্ত কোনো শ্রমিক নেই। ৪০ হাজার টাকা চুক্তিতে ওই রাস্তায় ৭ শ্রমিক কাজ করছেন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চরচটাং গ্রামে অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে ২০ শ্রমিকের বিপরীতে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ইউপি সদস্য গিয়াস উদ্দিন তার পরিবারের সদস্যদের নামের তালিকার বিকাশ নম্বর দিয়ে ওই টাকা তুলেছেন। সেই প্রকল্পে ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ধানখেতে ৫০ মিটার রাস্তা সংস্কার করে বাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নতুন প্রকল্পে কাজ করা শ্রমিক নুরুজ্জামান বলেন, তারা সাত শ্রমিক ৬ দিন কাজ করে ১০০ মিটার রাস্তা সংস্কার করেছেন। আরেকটি রাস্তার ৯০ মিটার সংস্কার করছেন। দুটি রাস্তায় তাদের ৮০ হাজার টাকা বিল দেওয়া হবে। ইউপি সদস্যের ছেলে আলিমুল চুক্তি অনুযায়ী তাদের টাকা দিচ্ছেন।
শ্রমিকদের তালিকায় প্রথমে থাকা আলিমুল ইউপি সদস্যের বড় ছেলে। তিনি স্থানীয় আংগারিয়া বাজারের ব্যবসায়ী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা মেম্বার। শ্রমিকদের বিল কাজের সঙ্গে সঙ্গে দিতে হয়। তাই আমাদের কয়েকজনের নামে বিল আসে। সেই বিল আগেই আমরা শ্রমিকদের দিয়ে দিই।’
ইউপি সদস্য গিয়াস উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য জানতে শরীয়তপুরে কর্মরত পাঁচ সাংবাদিক রোববার দুপুরে আংগারিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যান। সেখানে ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের কাছে বক্তব্য জানতে চাইলে হামলার ঘটনা ঘটে। তারা এখন টেলিভিশন ও চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা ফেলে দেন। প্রথম আলোর সাংবাদিকের মোটরসাইকেলের লুকিং গ্লাস ও হেলমেট ভেঙে ফেলেন।
চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের সাংবাদিক নুরুল আমীন এ প্রসঙ্গে বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান তাঁর লোকজন নিয়ে তাঁদের ওপর চড়াও হন। পরিষদের একটি কক্ষে আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যের ছেলে গালাগালি দিয়ে জীবননাশের হুমকি ও চাঁদাবাজি মামলায় জড়ানোর ভয় দেখান। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়েছে। তাঁরা আইনগত পদক্ষেপ নেবেন।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র বলেন, অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান প্রকল্পে কোনো অবস্থায় এক পরিবারের একাধিক ব্যক্তির নাম থাকা যাবে না। এটার কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সদরের পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আক্তার হোসেন বলেন, এক ইউপি চেয়ারম্যান কয়েক সাংবাদিকের ওপর হামলা করেছেন, এমন তথ্য পেয়েছেন। তাঁরা লিখিত অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসডব্লিউএসএস/২১২০
আপনার মতামত জানানঃ