পুরান ঢাকার ঠাটারী বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ বাজার ভবন ভাঙার পর বিপাকে পড়েছেন সবজি ও মাছ ব্যবসায়ীরা। বাজারের উন্মুক্ত স্থানে ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়ার নামে গত দুই বছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
উল্লেখ্য, আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ মন্নাফী’র ছেলে।
ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিরা বলছেন, নিয়ম মেনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে ঠাটারী বাজারে দোকানের বরাদ্দ নিয়েছেন তারা। তাদেরই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে করপোরেশন ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে দেয়। এরপর কাউন্সিলর ইমতিয়াজ সেখানে ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়ার নামে দুই বছর টাকা আদায় করেন। তার চাচাতো ভাই ইয়াছির ইলিয়াসকে দিয়ে তিনি কাজটি করেন। তবে গত ২৩ অক্টোবর গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবর সংগ্রহ করতে যাওয়ার পর টাকা আদায় বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটির মেয়র মোহাম্মদ হানিফের সময় ঠাটারী বাজারে একতলা একটি ভবন নির্মাণ করে ১৯৯ ব্যক্তিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২২ বছর পর তার ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন এসব ব্যক্তিকে চূড়ান্ত বরাদ্দপত্র দেন। দোকানপ্রতি মাসে ৮০০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।
দোকানিরা অভিযোগ করেন, ভবনটি ভাঙার পর কাউন্সিলরের লোকজন সেখানে টিন দিয়ে সীমানাপ্রাচীর দিতে চেয়েছিলেন। সীমানাপ্রাচীর না করেই ব্যবসা করার সুযোগ দিতে কাউন্সিলরকে অনুরোধ করেন দোকানিরা। তখন স্থানীয় কাউন্সিলর ব্যবসা করতে হলে রাজস্ব দিতে হবে জানিয়ে বিষয়টি নিয়ে তার চাচাতো ভাই ইয়াছিরের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
ইয়াসির দোকানিদের বলেন, ব্যবসা করতে হলে দিনে দোকানপ্রতি ২০০ টাকা করে দিতে হবে। নিরুপায় হয়ে ১৯৯ দোকানি কাউন্সিলরকে দিনে ৩৫ হাজার টাকা দিতে রাজি হন। এভাবে তাঁরা ছয় মাস কাউন্সিলরের লোকজনকে দৈনিক ভিত্তিতে টাকা দেন। পরের ছয় মাস সব দোকানি মিলে দিনে দেন ২৮ হাজার টাকা করে। এরপর গত ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত পরের এক বছর দিনে ৩১ হাজার টাকা করে দেন।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে দেওয়া এক লিখিত আবদনে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, তাদের কাছ থেকে জোর করে টাকা নেওয়া হচ্ছে। অথচ সব নিয়ম মেনে তারা সিটি করপোরেশন থেকে চূড়ান্তভাবে দোকান বরাদ্দ পেয়েছেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ভাড়াও দিচ্ছেন। ভবন ভেঙে ফেলার পর সিটি করপোরেশন ভাড়া নিচ্ছে না। অথচ দোকানিদের জিম্মি করে স্থানীয় কাউন্সিলরের চাচাতো ভাই ইয়াছির প্রতিদিন টাকা আদায় করছেন।
দোকানিরা অভিযোগ করছেন, ঠাটারী বাজারে নতুন ভবন না করে উন্মুক্ত জায়গায় বাজার পরিচালনা করতে কাউন্সিলরের স্বজনকে ইজারাদার নিয়োগ দিয়েছে দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি বিভাগ। এভাবে বাজার ইজারা দেওয়া আইনসম্মত নয়। তাই তারা উচ্চ আদালতে গেছেন। কারণ, চূড়ান্ত দোকান বরাদ্দ দেওয়ার পর ইজারাদার নিয়োগের যৌক্তিকতা নেই।
তবু সিটি করপোরেশন এ অবস্থায় ভাড়া নিতে চাইলে তাদের দিতে আপত্তি নেই। সিটি করপোরেশনকে মাসে ভাড়া দিতে হয় ৮০০ টাকা। এখন প্রতিদিনই চাঁদা দিতে হচ্ছে ২৭০ টাকা। আর কাউন্সিলরের আত্মীয়কে ইজারা দেওয়ার অর্থ এত দিন ধরে যে চাঁদাবাজি চলছে তাকে বৈধতা দেওয়া।
তবে ইজারাদার মো. কামরুজ্জামান দাবি করেন, তিনি স্থানীয় কাউন্সিলরের আত্মীয় নন। ইতিমধ্যে তিনি কার্যাদেশ পেয়েছেন। তবে সিটি করপোরেশন এখনো তাকে বাজার বুঝিয়ে দেয়নি।
তবে দেখা গেছে, ভাঙা ভবনের জায়গায় ত্রিপল টাঙিয়ে দোকান পরিচালনা করছেন ব্যবসায়ীরা। বাজারে মূলত মাছ ও শাকসবজি বিক্রি করা হয়। ব্যবসায়ীরা বলেন, মো. জামাল নামের এক দোকানির মাধ্যমে প্রতিদিন ৩২ হাজার টাকা তোলা হয়। পরে তা কাউন্সিলর কার্যালয়ের নিচতলায় এক দোকানে জমা রাখা হয়। সেখান থেকে কাউন্সিলরের আত্মীয় ইয়াসির এই টাকা নিয়ে যান।
দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ বলছে, সম্পত্তি বিভাগ থেকে তারা এখনো জমি বুঝে পাননি। তাই ভবন নির্মাণের প্রাথমিক কাজই তাঁরা শুরু করতে পারছেন না। যোগাযোগ করা হলে সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, অনুমোদনের জন্য অনেক আগেই ফাইল মেয়রের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
তবে সিটি করপোরেশনের দুই বিভাগের এমন গাছাড়া ভাবকে অন্যভাবে দেখছেন কাপ্তান বাজার ও ঠাটারী বাজার মৎস্য–কাঁচামাল–সবজি বিক্রেতা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমিতির শীর্ষ এক নেতা অভিযোগ করেন, স্থানীয় কাউন্সিলর নতুন ভবন নির্মাণের দরপত্র আটকে রেখেছেন। কারণ, নতুন ভবন হলে তার দৈনিক চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে।
কাঁচাবাজার ভবনের জায়গা ইজারা দেওয়া ও দোকানিদের কাছ থেকে স্থানীয় কাউন্সিলরের চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরীন বলেন, জায়গা খালি পড়ে থাকায় ইজারা দিয়ে রাজস্ব আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন ভবন হলে চূড়ান্ত বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিরা দোকান বুঝে পাবেন। কাউন্সিলরের লোকজনের টাকা আদায়ের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
বাজারের বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে কাপ্তান বাজার ও ঠাটারী বাজার মৎস্য-কাঁচামাল-সবজি বিক্রেতা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মান্নান বলেন, এখন চাঁদাবাজি বন্ধ আছে। তারা যেহেতু আদালতে গেছেন সে কারণে এখন দোকানমালিকদের সঙ্গে সমোঝোতা করতে চাইছেন কাউন্সিলর। কাউন্সিলরের সমঝোতার মূল উদ্দেশ্য, টাকা আদায় করা।
এসডব্লিউ/এসএস/২১০৪
আপনার মতামত জানানঃ