দেশে পোল্ট্রি খাতে মহাবিপর্যয় নেমেছে। চলমান লোড শেডিং, পোল্ট্রি খাদ্যের উচ্চমূল্য এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মূলত এ সবের কারণে খামারে মুরগীর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক উদ্যোক্তা তাদের খামার গুটিয়ে নিয়েছেন। বিগত ছয় মাসে প্রায় ১০ হাজার পোল্ট্রি খামার কমে গেছে। ঘাটতির কারণে বেড়েছে মুরগি ও ডিমের দাম।
এদিকে, বাজারে ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা এবং সোনালি ২৯০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ডিমের হালি ৪৫-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও ফিডের কাঁচামালের দাম বাড়ায় গেল এক বছরে প্রাণিজ খাবারের উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বহন না করতে অনেকে খামার বন্ধ করে দিয়েছে। গত চার বছরে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় প্রায় ১ হাজার ৯০০ খামার বন্ধ হয়ে গেছে।
পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মহসিন বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে অতিরিক্ত খরচ করে বড় খামারিরা জেনারেটর ব্যবহার করতে পারলেও ছোট খামারিরা এই ব্যয় বহন করতে পারছেন না। তার উপর পোল্ট্রি খাদ্যের উচ্চমূল্য। চারিদিক থেকে খামারিদের লোকসান হওয়ায় গত ছয় মাসে ১০ হাজারের বেশি খামার বন্ধ হয়ে গেছে।
কতটা সংকটে পোল্ট্রি শিল্প
বিশ্ববাজারে ভুট্টা ও গমের দাম কয়েক দফা বেড়েছে। একই সঙ্গে সয়ামিলসহ অন্যান্য কাঁচামালের দামও বাড়তি। এতে দেশের বাজারেও পোল্ট্রি খাবারের দাম বেড়ে গেছে। এ কারণে অনেক খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। আবার কেউবা উৎপাদন করছেন কম।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য অনুযায়ী, পোল্ট্রি খাদ্যের কাঁচামালের দাম অনেক ক্ষেত্রে গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে যে ভুট্টার দাম ছিল প্রতি কেজি ১৭ টাকা ৩০ পয়সা, চলতি বছরের আগস্টে সেই দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ টাকা ৩০ পয়সায়।
পোল্ট্রি খাবারের অন্যতম উপাদান সয়ামিলের দামও বেড়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে প্রতি কেজি সয়ামিলের দাম ছিল ৪৭ টাকা ৭০ পয়সা, চলতি বছরের আগস্টে তা বেড়ে হয়েছে ৭২ টাকা। একই সময়ে পোল্ট্রি খাবারের দাম বেড়েছে প্রতি কেজি ৭২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৭৮ টাকা। এ ছাড়া পোল্ট্রি খাবারের অন্যান্য উপাদান, চালের কুঁড়া, ক্যানোলা মিল, গমের আটা, সাধারণ লবণসহ অন্যান্য উপকরণের দামও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বিপিআইসিসির পক্ষ থেকে লিখিতভাবে জানানো হয়, দেশে মুরগির খাবার তৈরির মিলগুলো কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে জটিলতার মুখে পড়েছে। তাতে আমদানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে পোল্ট্রিশিল্পে আরও বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে।
মুরগির খাবারের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ-সংকটের কারণে ক্ষুদ্র খামারিরা ব্যবসা সংকুচিত করে নেওয়ায় কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন ক্ষুদ্র মুরগি খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার।
পোল্ট্রিশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিপিআইসিসি ও বিপিএ বলছে, চলতি বছরের মাঝামাঝিতে দেশে ৮০ থেকে ৯০ হাজার ছোট-বড় মুরগির খামার ছিল। গত কয়েক মাসে ১০ থেকে ১৫টি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ করোনার আগে দেশের মুরগির খামারের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি। লোকসানের কারণে দিন দিন খামারের সংখ্যা কমছে।
বিপিআইসিসি ও বিপিএর তথ্য অনুযায়ী, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুরগির খামারের সঙ্গে ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। আর পোল্ট্রিশিল্পের বাজারের আকার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু যেভাবে খামার বন্ধ হচ্ছে, তাতে বাজারের আকার কমে যাবে বলে জানান সংগঠন দুটির নেতারা।
পোল্ট্রি উদ্যোক্তারা বলেন, ডিম থেকে বাচ্চা তৈরিতে ইনকিউবেটরসহ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। চলমান লোড শেডিংয়ের কারণে ব্রয়লারের বাচ্চা উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। তার সাথে যোগ হয়েছে পোল্ট্রি খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি। পোল্ট্রি খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও লোডশেডিংয়ের কারণে খামারিরা দিশহারা।
বড় খামারিরা জেনারেটর ব্যবহার করতে পারলেও ছোট খামারিরা পারছে না। অতিরিক্ত গরমের কারণে অনেকের মুরগি মারা যাচ্ছে। খরচ বহন করতে না পেরে অনেক খামারিই উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছেন। অনেকেই গুটিয়ে নিয়েছেন ব্যবসা। ফলে সৃষ্টি হয়েছে ঘাটতি।
যা বলছে সংশ্লিষ্টরা
গাজীপুর এলাকার মুরগির খামারি আজমল কাদীর বলেন, খুচরা বাজারে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৭০ থেকে ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, অথচ পাইকারিতে খামারিরা দাম পাচ্ছেন ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। পাইকারিতে প্রতিটি ডিম ৯ টাকায় বিক্রি হলেও ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি। পাইকারি দামের চেয়ে খুচরায় ৩ টাকা বেশি দামে ডিম বিক্রি হলেও খামারিরা এর কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না।
এদিকে খাবারের বাড়তি দামের সমস্যার পাশাপাশি খামারিদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে বিদ্যুৎ-সংকট। বিদ্যুৎ না থাকায় অনেক খামারিকে বিকল্প হিসেবে জেনারেটর ব্যবহার করতে হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ ক্ষেত্রেও খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে তাই উৎপাদন খরচ বাড়তি। খামারিরা বলছেন, শীত মৌসুমে মুরগির বাচ্চা ফুটাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। সেটি না পেলে খামারিরা আরও ক্ষতির মুখে পড়বেন।
এক বছর আগেও নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার পোল্ট্রি খামারি শামসুর রহমানের খামারে ১০ হাজার ব্রয়লার মুরগি ছিল। ব্যবসা ছিল রমরমা। সেই খামারে এখন মুরগি আছে ৫ হাজারের মতো। গত এক বছরে মুরগির খাবারের মূল্যবৃদ্ধি ও মুরগির বাড়তি দাম না পাওয়ার শামসুর রহমানের ২৫ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ফলে ব্যবসা সংকুচিত করে ফেলেছেন তিনি।
শামসুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ বছরের শুরুতেও ব্রয়লার মুরগির খাবারের দাম ছিল প্রতি কেজি গড়ে ৪৭ টাকা। এখন সেই খাবার কিনতে হচ্ছে ৬৮ টাকায়। ২০০ থেকে ২৫০ টাকার ওষুধের ভায়ালের দাম বেড়ে হয়েছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। আবার কয়েক মাস ধরে বিদ্যুৎ-সংকটের কারণে জেনারেটরের ব্যবহার বেড়েছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ, কিন্তু সেই তুলনায় দাম পাচ্ছি না।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ