প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি আমাদের কালচারে পরিণত হয়েছে। সেটা দেশের যেকোন প্রান্তেই হোক, প্রতিটি প্রকল্পের একই চিত্র। তা সে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বন্দর নগরী চট্টগ্রাম হলেও। ২০১১ সালে ‘চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোড’ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। উদ্দেশ্য ছিল শহরের যানজট নিরসনসহ বেশ কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন। একে একে ১১টি বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি কাজ। মেয়াদ বেড়েছে সাত দফা। নতুন করে চতুর্থ দফায় ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ায় ৮৫৬ কোটি ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকার প্রকল্প গিয়ে ঠেকেছে ৩ হাজার ৩৪৯ কোটি ১৯ লাখ ৪১ হাজার টাকায়। উল্লেখ্য, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, জানুয়ারি ২০১১ থেকে ডিসেম্বর ২০১৪ মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাবে ব্যয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৯৬ কোটি ৩৫ লাখে, তৃতীয় প্রস্তাবে ব্যয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৭৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা। চতুর্থ ধাপে ৩ হাজার ৩৪৯ কোটি ১৯ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়। ফলে মূল প্রকল্প থেকে চতুর্থ সংশোধিত প্রস্তাব পর্যন্ত ব্যয় বাড়ছে ২ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা।
মেয়াদ বাড়ার কারণ
ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রকল্পের মেয়াদও। একে একে সাতবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। প্রথমে প্রকল্পের কাজ জানুয়ারি ২০১১ থেকে ডিসেম্বর ২০১৪ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। এর পরে জুন ২০১৭ সাল নাগাদ মেয়াদ বাড়ানো হয়।
পর্যায়ক্রমে কয়েক দফায় জুন ২০১৯, জুন ২০২০, জুন ২০২১, ডিসেম্বর ২০২১, ডিসেম্বর ২০২২ সাল নাগাদ মেয়াদ বাড়ে। এই মেয়াদেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। নতুন করে জুন ২০২৪ সাল নাগাদ মেয়াদ বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ক্রমাগত মেয়াদ বৃদ্ধির বেশ কিছু কারণ আছে।
সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজের নকশা পরিবর্তন
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা নকশা ও প্রাক্কলন অনুসারে অনুমোদিত তৃতীয় সংশোধিত ডিপিপিতে রিং রোডের সঙ্গে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) সংযোগ সড়ক নির্মাণ ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে অনুযায়ী নির্মাণকাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়।
নির্মাণকাজ করার প্রাক্কালে দেখা যায়, তৃতীয় সংশোধিত ডিপিপি প্রণয়নের সময় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নকশা করার ক্ষেত্রে মাটির যে বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করেছিল বাস্তবে কিছু কিছু অংশে তার ভিন্নতা রয়েছে। সে কারণে মাটির বৈশিষ্ট্য ও জায়গার সীমাবদ্ধতার কারণে আগের ড্রয়িং ডিজাইন অনুযায়ী কাজটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
সংশোধিত নকশা অনুসারে রিং রোডের সঙ্গে সিইপিজেডের সংযোগ সড়কটি নির্মাণ এবং সিইপিজেডের অনুরোধে রিং রোড সংলগ্ন সিইপিজেডের কয়েকটি অংশে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ বাবদ অতিরিক্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ১২১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
এলইডি স্ট্রিট লাইট অন্তর্ভুক্তকরণ
প্রকল্প এলাকাটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় এবং ভৌগোলিক কারণে রাস্তাটি সাগরপাড়ে হওয়ায় রাতে যানবাহন দুর্ঘটনা রোধ জরুরি। এজন্য রাস্তার উভয় পাশে এলইডি সোলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৯৪৯টি স্ট্রিট লাইট অন্তর্ভুক্তির কারণে ব্যয় বাড়ছে ১২ কোটি ১০ লাখ টাকা। এলইডি স্ট্রিট লাইট বারের মধ্যে ১৫০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন লাইট, ডাটা কন্ট্রোল ইউনিট, কন্ট্রোল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সফটওয়্যার, স্টিল বডি এমডিবি/ডিবি/এসডিবি, গ্রিল কেস, জিআই পাইপ, পিভিসি পাইপ, ২৯ ফুট দীর্ঘ জিআই গোল, ক্যাবল, ট্রান্সফরমার, ড্রপ আউট ফিউস, আয়রন চ্যানেল, ফাউন্ডেশনসহ আনুষঙ্গিক কাজ অন্তর্ভুক্ত।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
বারবার প্রকল্পের সময়-ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘টানেল ইন্টারসেকশন ও জমি অধিগ্রহণের কাজ বাকি। রেললাইনের ওভার ব্রিজের অনুমতি লাগবে। এসব কারণে সংশোধন করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশন অযৌক্তিকভাবে আমাদের প্রস্তাব কমিয়ে দিয়েছে। প্রথমে ১৫শ কোটি টাকার প্রস্তাব পাঠানো হয়। পরিকল্পনা কমিশন ৮৫৬ কোটির অনুমোদন দেয়। পরে দ্বিতীয় সংশোধনে ১ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। নানান কারণে কাজটা শুরু হয় ২০১৭ সালে। প্রকল্পে বিশাল একটি বাঁধ নির্মাণ করেছি। এটার ওপর সড়ক তৈরি করেছি। টানেল সংযোগ না থাকলে তৃতীয় সংশোধনে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হতো।’
ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন
প্রকল্পের নানা খাতের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। ডিজাইন ও সুপারভিশনের জন্য পরামর্শক বাবদ প্রায় ১৮ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে, যা অধিক বলে মত দিয়েছে কমিশন। প্রকল্পের মেয়াদব্যাপী পরামর্শকের সংস্থান না রেখে সুনির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের চুক্তিতে (অ্যাসাইনমেন্ট বেজড) পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে এ ব্যয় কমানো সম্ভব কি না সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
প্রকল্পের আওতায় কেনা একটি জিপ, একটি পিকআপ এবং তিনটি মোটরসাইকেলের জন্য ২৫ লাখ টাকা জ্বালানি ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মাসিক জ্বালানি প্রাপ্যতার ভিত্তিতে নির্ধারণপূর্বক ব্যয় কমানো উচিত বলে মনে করে কমিশন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ