রাশিয়া থেকে কম দামে তেল আমদানির উপায় বের করতে কয়েক দিন ধরে সরকারের বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার করে হলেও রাশিয়া থেকে তেল আমদানির চিন্তাভাবনা করছিল সরকার। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ডলারের বিপরীতে বিকল্প মুদ্রায় রাশিয়া থেকে তেল আমদানি সম্ভব নয়।
কারণ, বিশাল অঙ্কের রাশিয়ান মুদ্রা রুবল বাংলাদেশের পক্ষে জোগান দেওয়া অসম্ভব। তা ছাড়া নিষেধাজ্ঞার কারণে ডলারেও রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা যাবে না। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই কম দামে অন্য কোনো দেশ থেকে তেল আমদানি করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বৈঠকে।
‘পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি’ পর্যালোচনা করতে গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। রাশিয়া থেকে তেল আমদানিতে সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে গতকালের এই সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে আলোচনা হয়, রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বেশ কঠিন। প্রক্রিয়াও জটিল। দেশটি তাদের নিজস্ব মুদ্রায় তেল রপ্তানির আগ্রহ দেখিয়েছে। চাইলে ডলারেও পরিশোধ করা যাবে।
কিন্তু তেল আমদানিতে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল জোগান দেওয়া বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ততটা নেই। সবচেয়ে বড় বিষয়, দেশটি থেকে তেল আমদানি করলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেয়, সেটিও মাথায় রাখতে হবে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ‘বৈঠকে আমরা জানতে চেয়েছি, রাশিয়া থেকে কোন পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে আর কোন পণ্যে নিষেধাজ্ঞা নেই। জানতে পারলাম, জ্বালানি তেলের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমরা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে তেল আমদানি করতে পারব না।’ তিনি বলেন, তেলের দাম বাড়ছে। তাই যেসব জায়গায় তেলের দাম কম, সেখান থেকে তেল আমদানি করতে হবে।
কোভিডের ধাক্কা সামলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কয়েক মাস ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়তির দিকে। এ কারণে দেশের আমদানি খরচ বেড়েছে। আবার গত অর্থবছরে প্রবাসী আয়ও কমেছে। তাই চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি ডলারের দাম ৮৬ থেকে বেড়ে ৯৫ টাকা হয়। খোলাবাজারে দর ১১৫ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। বাড়তি আমদানি খরচ মেটাতে গিয়ে বৈদেশিক রিজার্ভ কমে গেছে। লেনদেনের ভারসাম্যে দেখা দিয়েছে বড় ঘাটতি। এমন বাস্তবতায় ডলার-সংকট মোকাবিলায় বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের আলোচনা উঠে আসে।
গতকালের বৈঠকে উপস্থিত ওষুধশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাশিয়া থেকে তেল আমদানির সিদ্ধান্ত আসতে হবে রাজনৈতিকভাবে। এটি কূটনীতিরও অংশ। রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করলে পশ্চিমা বিশ্ব বিষয়টি কীভাবে দেখে, তা-ও মাথায় রাখতে হবে। সব দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করলে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা পর্যালোচনা করা উচিত।
অবশ্য ভারত কীভাবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করছে, তা নিয়ে গতকালের বৈঠকে আলোচনা হয়। এ নিয়ে বলা হয় যে ভারত সরকার জানিয়েছে, নিজ দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে যেটি শ্রেয়তর, সেটিই করবে তার সরকার। অর্থাৎ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে পরোয়া করছে না তারা। তারা রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করছে।
বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে লেনদেন করতে পারছে এমন ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করে দেশ দুটি থেকে তেল আমদানির চিন্তা করছে সরকার। অন্যান্য খাদ্যশস্য আমদানির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য আমদানিতে ২৪টি বৈশ্বিক ব্যাংক খাদ্যশস্য আমদানিপত্র বা এলসি খুলতে রাজি হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে সার এবং খাদ্যশস্য আমদানির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
গতকালের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, কম দামে অন্য কোন দেশ থেকে তেল কেনা যায়, তা খতিয়ে দেখা। এ ছাড়া তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে তেল কেনা যায় কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা। বিশেষ করে ভারতের উদাহরণটি বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। রাশিয়া থেকে কোন প্রক্রিয়ায় তেল আমদানি করছে ভারত। সে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ যেতে পারবে কি না। অথবা তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ভারতকে অনুরোধ করে তেল আনা যায় কি না, সে বিষয়েও আলোচনা হয়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর গতকালের বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো অসন্তুষ্ট হতে পারে। যদি তেল আমদানি করতে হয়, তাহলে ওই সব দেশের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মতামত নিতে পারে সরকার। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে ভালো উপায় হবে তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে তেল আমদানি করা। সেটি হতে পারে ভারত, চীন ও তুরস্ক। এ তিনটি দেশের যেকোনো একটি দেশ থেকে সরকার চাইলে তেল আমদানি করতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/০৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ