গণশুনানি ছাড়াই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কেন অবৈধ নয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আজ এ রুল জারি করেন।
এ রিটের পক্ষে অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ ও ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ কুমার রায় শুনানি করেন।
এর আগে গত ৮ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ। রিটে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে জারি করা গেজেট স্থগিত, বাতিল ও প্রত্যাহার চাওয়া হয়। রিটে জ্বালানি সচিব, জ্বালানি উপ-সচিব ও বিইআরসির চেয়ারম্যানকে বিবাদী করা হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট জ্বালানির দাম ৪২.৫ শতাংশ থেকে ৫১.৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। ২০০১ সালের পর এটিই জ্বালানির দামের সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।
নতুন মূল্যে প্রতি লিটারে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৩৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ আগের মূল্য ৮০ টাকার বদলে এখন এ জ্বালানিগুলো কিনতে ক্রেতাকে গুণতে হবে ১১৪ টাকা। অন্যদিকে অকটেন ও পেট্রোল লিটারপ্রতি ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে।
এর আগে ২০০৮ সালের ২৭ অক্টোবর ডিজেলের সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধি ছিল কেবল ৩৭.৫ শতাংশ। কিন্তু এবার ডিজেলের দাম বেড়েছে ৪২.৫ শতাংশ এবং অক্টেনের ৫১.৬ শতাংশ।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আরও একটি বিতর্ক আছে। আর সেটা হলো, বিশ্ববাজারের রেকর্ড কম দামের বিপরীতে তেলের দাম ততটা না কমিয়ে সবশেষ পাঁচ মাস বাদে গত সাত বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। বিপিসির লাভ যখন লিটারপ্রতি ১৫-৪০ টাকা ছিল, তখন বহু সমালোচনার পর এপ্রিল ২০১৬ সালে মাত্র ৩ টাকা কমানো হয়েছিল! (সূত্র: লিটারে বিপিসির লাভ ১৫-৪০ টাকা; প্রথম আলো, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬)।
এরপর ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোর সুযোগ না পেয়ে কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি লিটার ডিজেলে ১৩ টাকা লোকসান দেখিয়ে এক ধাক্কায় ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকা করা হলো। সাত বছর ধরে গড়ে ২৩ শতাংশের বেশি লাভের বিপরীতে কমানো হয়েছিল মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। অথচ পাঁচ মাসের লোকসান দেখিয়ে ডিজেল-কেরোসিনের দাম এক লাফে ২৩ শতাংশ বাড়ানো কি গ্রহণযোগ্য হলো?
সরকার বিপিসিকে ভর্তুকি দেয়, তবে বিপিসির কাছ থেকে শুল্ক, কর, ভ্যাট বা মূসক বাবদ আয়ও করে। লোকসানের হিসাবটা সরল নয়। লিটারপ্রতি ডিজেলে ১১ টাকা ভ্যাটসহ অন্যান্য শুল্ক প্রায় ১৭ টাকার বেশি। প্রাথমিক জ্বালানির ওপর ২৫ শতাংশের বেশি শুল্ক-মূসক আদায় অর্থনৈতিক দিক থেকে আত্মঘাতী নয় কি? সরকারের আয় বাড়াতে পণ্য উৎপাদন খরচ এবং ব্যবসা সহজীকরণের প্রাথমিক ভিত্তিতেই বাধা তৈরির যৌক্তিকতা কোথায়?
গ্যাসপ্রাপ্তির সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকার প্রভাব পড়েছে দেশের বিদ্যুৎ খাতে, এটা আপাত সত্য, চূড়ান্ত সত্য নয়। এক বছরে পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড-পিডিবির লোকসান বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ, অঙ্কের হিসাবে ১১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা।
তথাপি, ভাড়ায় চালিত অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। বছরে এক মেগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই বেশ কিছু অলস বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তির দোহাই দিয়ে ‘অপ্রমাণিত ও মিথ্যা সক্ষমতা’র বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। লোকসান সমন্বয়ে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট কমানোর উদ্যোগ নেই। নিজস্ব কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারত থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে চার হাজার কোটি টাকার।
বিপিসি পরিশোধিত-অপরিশোধিত তেল আমদানিতে একক মনোপলি কোম্পানি। ভর্তুকি কমানোর জন্য দাম বাড়ানো হয়, কিন্তু বিপিসির সিস্টেম লস ও দুর্নীতির থামানোর উদ্যোগ নেই। তেল চুরি এবং আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে তেল ক্রয়ের নিয়মিত অভিযোগ আছে বিপিসির বিরুদ্ধে।
আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম শূন্য ডলারের কাছাকাছি ছিল অন্তত করোনাকালে দেড় বছর, ছিল শুধু জাহাজ খরচ। কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রকে সরাসরি তেল কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা বৈষম্যপূর্ণ।
বিপিসির একক মনোপলি বন্ধ করে, কথা ছিল বিপিসি এবং বেসরকারি কোম্পানিরা উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কিনবে এবং এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আমদানি করা তেলের মান, সিস্টেম লস, দুর্নীতি, তেলের ভেজাল মেশানো এবং পরিবেশগত বিষয় অডিট করবে। প্রাথমিক জ্বালানি আর কত দিন সরকারের আয়ের উৎস থাকবে? কিছুদিন পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে গেলে জ্বালানির দাম সঙ্গে সঙ্গে কমানো হবে কি?
অক্টোবরেই ১২ কেজির একেকটি সিলিন্ডারের মূল্য ১ হাজার ৩৩ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ১ হাজার ২৫৯ টাকা। এখন এলপিজির দাম আবারও ১ হাজার ২৫৯ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৩১৩ টাকা করা হয়েছে। এ নিয়ে টানা পঞ্চম মাসে বাড়ল এলপিজির দাম।
তেলের দাম বৃদ্ধির মাত্র ছয় ঘণ্টার মধ্যে বাস ভাড়া ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার ঘটনা ঘটছে। লঞ্চের ভাড়া দ্বিগুণ করার দাবিতে বিআইডব্লিউটিএকে চিঠি দিয়েছে লঞ্চ মালিক সমিতি। ভাড়া কত বাড়ানো উচিত এটা ঠিক হওয়ার আগে, জ্বালানি খরচ ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির যুক্তি কী—এই মীমাংসা হওয়া উচিত নয় কি? সরকার কি দাম বাড়ানোর আগে একটা গণশুনানি করারও ধার ধরেছে? সুশাসন ও জবাবদিহি আজ কোথায়?
সমুদয় অর্থনীতি প্রাথমিক জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু প্রাইমারি জ্বালানির দাম ২৩ শতাংশ বেড়ে গেছে (৫-৭ শতাংশ নয়) তাই বিদ্যুৎ পরিবহন শিল্প উৎপাদনসহ যাবতীয় পণ্য মূল্য ভাড়াসহ সমুদয় খাতে মূল্যবৃদ্ধির চক্র শুরু হয়ে যাবে। ডিজেল ও ফার্নেস তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়বে।
১২ বছরে সরকার পানির দাম ১৪, বিদ্যুৎ মূল্য ১২ এবং গ্যাসের দাম ৯ বার বাড়িয়েছে। গত সাত বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল- গ্যাসের মূল্য যখন নিম্নমুখী ছিল, তখন সরকারের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর যুক্তি কি সঠিক ছিল?
তরল প্রাথমিক জ্বালানির আন্তর্জাতিক মূল্য নিম্নমুখী থাকার সময় সেকেন্ডারি জ্বালানির দাম উপর্যুপরি বাড়ানো হয়েছিল কেন? আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কম থাকলে বিদ্যুতের দাম বাড়বে, বেশি হলে প্রাইমারি জ্বালানির দাম বাড়বে—এটা কি ব্যবসা ও জনবান্ধব কৌশল?
এসডব্লিউ/এসএস/২০১০
আপনার মতামত জানানঃ