বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য, সম্প্রতি যার প্রদর্শনী হয়েছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সময়, ইসলামপন্থীদের দমিয়ে রাখা কিংবা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দ্বন্দ্বকে চতুরভাবে সামলানোর দক্ষতা—এই সব কিছুর আড়ালে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের কঠিন আরেক বাস্তবতা। এই বাস্তবতায় শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদ যেমন আছে, তেমনি আছে ক্রমেই তীব্র হতে থাকা বিভাজন ও অর্থনৈতিক দুর্দশা।
হাসিনার পায়ের নিচে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি দিনকে দিন নড়বড়ে হয়ে উঠছে। এই নড়বড়ে হয়ে উঠার গতি অনেকটাই ধীর; ফলে একে জরুরি সমস্যা নয় বলে অগ্রাহ্য করা যেতে পারে। কিন্তু অবিলম্বে মোকাবেলা করা না হলে, এটি নিশ্চিতভাবেই জগদ্দল হয়ে উঠবে।
২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন; আর ২০২৪ সাল থেকে শুরু হবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কিস্তি। ফলে এই চাপিয়ে দেয়া স্থিতিশীলতার বহিরাবরণের চাকচিক্য হারানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। হাসিনার এই কথিত তাসের ঘর পুরোপুরি ধসে না পড়লেও, টলে উঠার ঝুঁকি সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বেড়েছে।
আর এর ফলে নিজেদের নিকট-পূর্বাঞ্চলে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে ভারতের উচ্চাকাঙ্খা অবশিষ্ট যা আছে, তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
অভ্যন্তরীণভাবে, হাসিনা সরকার ঐতিহ্যগতভাবেই দুই মেরুতে বিভাজিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজে দুইটি পারস্পরিক সংঘাত তীব্র করে তুলেছে। এর প্রথমটি হলো, তিনি ক্ষমতায় আছেন, কিন্তু তার কোনো নির্বাচনী বৈধতা নেই; থাকলেও, অতি সামান্য।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কারসাজি (এই কারসাজির চর্চা কেবল জাতীয় নির্বাচন ও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ নয়) , প্রধান প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) অবিরাম হেনস্থা করে যাওয়া, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা, উন্নত ডিজিটাল নজরদারির যন্ত্রসামগ্রী ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কড়া নজরদারি করা এবং ইসলামি ডানপন্থী রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করার পর আবার ভারসাম্য বজায় রাখতে তাদের দিকেই জোর করে ঝুঁকে যাওয়া—এই সব মিলিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার বহু ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান একটি একদলীয় রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু তিনি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হন। পিতার বিপরীতে গিয়ে হাসিনা উল্টো বাজি ধরেছেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর। এক্ষেত্রে যুক্তি হলো যে, ভালো অর্থনৈতিক পারফরম্যান্স আর উদারভাবে শক্তি ব্যবহার করলে হাসিনার নেতৃত্বাধীন একদলীয় রাষ্ট্রটি টেকসই হবে। কিন্তু এখানেই শুরু দ্বিতীয় দ্বন্দ্বের।
বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১.৮%, আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪৪%, ৪২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমশই কমছে, যা দিয়ে মাত্র পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে; আর তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে আসা রাজস্বের পরিমাণ রাজকোষের দ্রুত বাড়তে থাকা ব্যয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না।
এই পুরো পরিস্থিতির সঙ্গে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্র-আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বদৌলতে সৃষ্ট বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি যোগ করুন। পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে, অত্যন্ত স্ফীত খরচে অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ঝোঁক, যার ফলে ঋণ পরিশোধ কঠিনতর হয়ে উঠছে।
এক্ষেত্রে আদর্শ উদাহরণ হলো রাশিয়ার সাথে ২০১৫ সালে করা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি, যার জন্য ঢাকাকে ১৩.৫ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা গুনতে হবে। অথচ, কুদানকুলামে একই মানের একটি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ভারতকে সাকূল্যে ৩ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে।
ঢাকা এই ধরণের চুক্তি কেন মেনে নেয়? কারণ বৈদেশিক এসব অর্থায়নে অবকাঠামোগত প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া দেয়া যায়, পাশাপাশি অব্যাহত রাখা যায় গেঁড়ে বসে থাকা দুর্নীতি; একই সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রাজনৈতিক মায়াজালও অটুট রাখা যায়। তবে স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, হ্যাঁ, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক যাত্রাকে প্রশংসনীয় বললে কম বলা হয়।
কিন্তু কেউ যদি প্রত্যাশা করে যে, চমকপ্রদ অর্থনৈতিক উন্নতি, যেটি বহিঃ ও অভ্যন্তরীণ ঘাত-অভিঘাতের কারণে ক্ষীণ হয়ে যেতে বাধ্য, সেটির মাধ্যমে গণতন্ত্রের মোড়কে আচ্ছাদিত একটি দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামোকে জিইয়ে রাখা যাবে, সেটি হবে একটি অযৌক্তিক আবদার। হাসিনা নিশ্চিত করেছেন যে ইসলামপন্থীরা ও বিএনপি—এই দুই পক্ষের কেউই যেন তার ক্ষমতার দিকে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ গড়ে তুলতে না পারে।
কিন্তু হাসিনার আসল চ্যালেঞ্জ তার জানাশোনা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আসছে না। তার চ্যালেঞ্জ আসছে নিরাপত্তা কাঠামোর আধিপত্যাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নিজ দলের কাছ থেকে, যারা এত এত অবৈধ মুনাফা ঘরে তুলেছে যে, ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার কথা তারা কল্পনাও করতে পারে না।
এর ফলে হাসিনা এক কঠিন দোটানায় পড়েছেন। হয় তিনি সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে নিজের ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন; নতুবা তিনি ফের নির্বাচনে কারসাজি করে আন্তর্জাতিক নিন্দা কুড়াবেন, যার পরিণতিতে দেখা দিতে পারে গণআন্দোলন ও সহিংসতা। হাসিনার উত্তরসূরি বা স্থলাভিষিক্ত কে হবেন, সেই বিষয়ে স্পষ্টতা না থাকায়, উভয় পরিস্থিতিই সুযোগসন্ধানী কোনো প্রতিপক্ষকে ক্ষমতার পালাবদলে প্রলুব্ধ করতে পারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যার নজির দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভুরি ভুরি।
হাসিনার অভ্যন্তরীণ এই সমস্যার সঙ্গে তার বহিঃ নির্ভরশীলতার যোগসূত্র রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে হাসিনা নয়াদিল্লীর উপর নির্ভরশীল হওয়ায়, ভারত যে ক্রমেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ থেকে মানুষের অভিবাসন বা রোহিঙ্গা সংকটকে ঘরোয়া রাজনৈতিক সুবিধায় পরিণত করার যেই অপকৌশল হিন্দুত্ববাদীরা গ্রহণ করেছে, তা মোকাবিলা করা হাসিনার জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
তেমনি, চীনা অর্থ গ্রহণ করা রাজনৈতিক সমর্থনে রূপান্তরিত নাও হতে পারে। আবার অপরদিকে, বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী ইউনিট র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করতে ঢাকা হিমশিম খাচ্ছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি সফরের পর যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে সরিয়ে নেয়ার যেই সিদ্ধান্ত ঢাকা নিয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবে খুব সামান্যই প্রভাব ফেলবে।
এর সঙ্গে যোগ করতে হবে রোহিঙ্গা অভিবাসীদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর দাবি জোরালো হওয়ার প্রেক্ষাপট। এদের অনেককে গোপনে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়েছে, যা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যেই মনোভাব কঠোর হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি আরও টালমাটাল হয়ে উঠেছে। সহিংস হয়ে উঠতে পারে এমন কোন সংকট ঠেকাতে হলে হাসিনার দরকার মূলসড়কে উঠতে পারার কোনো পথ খুঁজে বের করা। এই উপমহাদেশের এখন যার একদমই দরকার নেই, সেটি হলো বাংলাদেশে অস্থিরতা।
সূত্র: নেত্র নিউজ
আপনার মতামত জানানঃ