ভারতে আটক হওয়ার পর প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) নাম নতুন করে আলোচনায় চলে এসেছে। একই সঙ্গে জোরেশোরে প্রশ্ন উঠেছে, জালিয়াতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের হোতা পি কে হালদারের পেছনে কারা। বলা হচ্ছে, পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনা হলে তার পেছনের রাঘববোয়ালদের সন্ধান মিলবে।
২০১৯ সাল থেকে পি কে হালদারের অর্থ কেলেঙ্কারি অনুসন্ধানের দায়িত্বে থাকা এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘শুরুতেই এই তদন্ত থামানোর জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর ওরফে এস কে সুর ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম।’
অন্যদিকে পি কে হালদার-সংশ্লিষ্ট তদন্তে আটক প্রায় সবাই আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে এস কে সুর ও শাহ আলমের নাম বলেন। অনেকেই এদেরকে পি কে হালদারের গডফাদার হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আটক রাশেদুল হক জবানবন্দিতে বলেন, ‘পি কে হালদারের নির্দেশেই তিনি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে যোগ দিয়েছিলেন। অর্থ লোপাটের তথ্য ধামাচাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক এক ডেপুটি গভর্নরকে দুই লাখ টাকা করে মাসোহারা দিতেন পি কে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিমকে ম্যানেজ করতে লাখ লাখ টাকা ঢেলেছেন পি কে হালদার, এমনটাও দাবি করা হয়েছে জবানবন্দিতে। তবে আরও বড় কোনো শক্তি পি কে হালদারের পেছনে আছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
সারা দেশ যখন ক্যাসিনোকাণ্ডে তোলপাড়, ঠিক তখনই সামনে আসে একটি নাম, প্রশান্ত কুমার হালদার। সংক্ষেপে তাকে ডাকা শুরু হয় পি কে হালদার। ঢাকা শহরের ক্লাব ও অভিজাত এলাকায় যখন ক্যাসিনোবিরোধী ধারাবাহিক অভিযানে গলদঘর্ম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ঠিক তখনই পি কের বোমা ফাটায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জালিয়াতির সঙ্গে ৭০-৮০ জন সম্পৃক্ত
পি কে হালদারের জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের এই অপকর্মের নেপথ্যের কুশীলব রাঘববোয়ালদের এখনো সামনে আনেনি দুদকসহ আইন প্রয়োগকারী অন্যান্য সংস্থা। বলা হচ্ছে, পি কের এই জালিয়াতির সঙ্গে ৭০ থেকে ৮০ জনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৬২ জনকে শনাক্ত করেছে দুদক।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের রেশ না কাটতেই ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পি কের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা ঠুকে দেয় দুদক। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারি করে আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোল।
একে একে বের হতে থাকে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে পি কে হালদারের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের ঘটনা। প্রকাশ হতে থাকে তার সহযোগীদের নামও। অভিযোগ আছে, দেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় এই আর্থিক কেলেঙ্কারির পেছনে রয়েছে রাঘববোয়ালদের প্রচ্ছন্ন সহায়তা।
এই রাঘববোয়ালদের এখনো সামনে আনেনি দুদকসহ আইন প্রয়োগকারী অন্যান্য সংস্থা। যদিও বিভিন্ন সময়ে জানা গেছে, পি কের এই জালিয়াতির সঙ্গে ৭০ থেকে ৮০ জনের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৬২ জনকে দুদক শনাক্ত করেছে বলে জানা গেছে। তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকে ডাকাও হয়েছে।
দুদক কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য মতে, পি কে হালদার পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) দায়িত্বে থেকেই প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা লুট করেছেন।
পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের নামে এখন পর্যন্ত ৩৯টি মামলা করেছে দুদক। দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ও গুলশান আনোয়ারের নেতৃত্বে করা টিম অনুসন্ধানের মাধ্যমে এসব মামলা করেন।
এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ১২ আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, শংখ বেপারী, রাশেদুল হক, অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ ১০ জন দোষ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া ১ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে।
আদালতের মাধ্যমে ৮৩ জনের বিদেশযাত্রায় দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। একই ইস্যুতে ৩৩ ব্যক্তির সম্পদ বিবরণী চেয়ে নোটিশ জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া ৮৩ জনের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও তাদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে রেখেছে দুদক।
পি কে হালদারের বান্ধবী ও সহযোগীরা
আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের ৮০ জন বান্ধবী থাকা নিয়ে একসময় তুমুল আলোচনা ছিল। তবে দুদকের তদন্তে এখন পর্যন্ত ১৫ জনের তথ্য মিলেছে। তারা হলেন অবন্তিকা বড়াল, শিমু রায়, নাহিদা রুনাই, পূর্ণিমা রানি, সুপ্তি চৌধুরী, শাহনাজ বেগম, হালি আকতার, সুস্মিতা, সামিয়া বেগম, অনিন্দিতা মৃধা, আতশী, পাপিয়া, শুভ্রা রানি, লামিয়া ও সাজিয়া রহমান।
এই বান্ধবীদের নামে ৮৬৭ কোটি পাচার করেছেন পি কে। কেবল তাই নয়, এসব বান্ধবীকে কোটি কোটি টাকার উপহার, গয়না ও ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন এই জালিয়াত।
এদের মধ্যে অবন্তিকা বড়ালকে ৪ কোটি ৩৫ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকায় ধানমন্ডির ১০/এ সড়কে ৩৯ নম্বর বাড়িতে ফ্ল্যাট কিনে দেন পি কে। যদিও অবন্তিকা আয়কর নথিতে তা গোপন রাখেন। গোপন রাখেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা নগদ ১০ কোটি টাকার তথ্যও। বর্তমানে তিনি আটক রয়েছেন।
শিমু রায়ের ব্যাংক হিসাবে ৬৫ কোটি টাকা দিয়েছিলেন পি কে। ময়মনসিংহের আলোচিত কুমির খামারের নামে এই টাকা নিয়েছিলেন তিনি।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ফাইন্যান্সের বাণিজ্য বিভাগের প্রধান নাহিদা রুনাইয়ের নামে কয়েক কোটি টাকা রেখেছিলেন পিকে, যা বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া হয়।
পূর্ণিমা রানির ব্যাংক হিসাবে ১০০ কোটি টাকা দেন পি কে। এই টাকা একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে দেয়া লোন হিসেবে দেখানো হয়। হালি আক্তারকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে দেন ৭০ কোটি টাকা। অবনিতার কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় ৮৪ কোটি টাকা।
সুপ্তি চৌধুরীকেও কোটি কোটি টাকা দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। যদিও তদন্ত শুরুর গন্ধ পেয়ে কানাডায় চলে যান পি কের এই বান্ধবী। কানাডায় তার আশ্রয়েই পি কে ছিলেন বলে প্রমাণ মিলেছে দুদকের তদন্তে।
বান্ধবী শাহনাজকে ৬০ কোটি টাকা দেন পি কে। আবার সুস্মিতা ও সামিয়া বেগমের কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে দেন ৬২ কোটি টাকা করে মোট ১২৪ কোটি টাকা।
অনিন্দিতা মৃধাকে উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল নামে ঠিকানাহীন প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় ৭০ কোটি টাকা। একই কায়দায় আতশি বেগমকে দেন ৮০ কোটি টাকা।
পাপিয়াকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক দেখান পি কে। এই পরিচয়ে এফএএস থেকে তাকে ১২০ কোটি টাকা ঋণ তুলে দেন তিনি। কাগুজে প্রতিষ্ঠানের পরিচয়ে শুভ্রা রানীকে দেয়া হয় ৮০ কোটি টাকা। একই কায়দায় সুস্মিতাকে দেয়া হয় ৭০ কোটি টাকা।
লামিয়া নামে একজন পার্টি এক্সপার্ট বান্ধবীও ছিল পি কের। তাকে নিয়ে হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টের পার্টিতে যেতেন পি কে। তার ব্যাংক হিসাবেও মিলেছে বিপুল টাকা। দুদককে দেয়া জবানবন্দিতে লামিয়া বলেছেন তার অতীত জীবনের সেই অধ্যায়।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাজিয়া রহমান নামে এক নারীও এসব পার্টিতে লামিয়ার সঙ্গী হতেন। তার হিসাবেও রয়েছে পি কের জালিয়াতির অর্থ। পি কে হালদার তার অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে বান্ধবীসহ ঘনিষ্ঠদের নামে সরিয়ে নেন বলে নিশ্চিত হয়েছে দুদক।
পি কে হালদারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় পি কের পরিবারের সদস্য, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধবী, সহযোগী, ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে নাম এসেছে প্রায় ১০০ জনের। এদের সবাইকে পিকের অর্থ লুটপাটের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত ও আসামি করেছে দুদক।
অর্থ লুটপাটে পি কে হালদারের সহযোগী হিসেবে যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান সুস্মিতা সাহা ও এমডি মৈত্রেয়ী রানী বেপারী, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম, পরিচালক মো. আবুল শাহজাহান, কাজী মাহজাবিন মমতাজ, মাহফুজা রহমান বেবী, সোমা ঘোষ, ডা. উদ্ভব মল্লিক, অরুণ কুমার কুণ্ডু, প্রদীপ কুমার নন্দী, এফএএস ফাইন্যান্সের স্বতন্ত্র পরিচালক বীরেন্দ্র কুমার সোম, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল শাহরিয়ার, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল হক গাঙ্গী, সিনিয়র অফিসার মৌসুমী পাল, ম্যানেজার আহসান রাকিব, প্রাক্তন সিনিয়র অফিসার তাসনিয়া তাহসিন রোজালিন, ভাইস প্রেসিডেন্ট মীর ইমাদুল হক, প্রাক্তন ডিপি মনিরুজ্জামান আকন্দ, সাবেক এসভিপি জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া এবং সাবেক এসইভিপি ও সিএডির প্রধান প্রাণ গৌরাঙ্গ দে।
সহযোগীদের মধ্যে আরও রয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাসুদের ব্যানার্জি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের পরিচালক নওশেরুল ইসলাম, অঞ্জন কুমার রায়, মোস্তাইন বিল্লাহ, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, আর বি এন্টারপ্রাইজের মালিক রতন কুমার বিশ্বাস, আর্থ-স্কোপ লিমিটেডের এমডি প্রশান্ত দেউরি, পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, নিউট্রিক্যাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান স্বপন কুমার মিস্ত্রি, ওয়াকামা লিমিটেডের চেয়ারম্যান সুব্রত দাস, পরিচালক সুভ্রা রাণী ঘোষ ও তোফাজ্জল হোসেন, কোলাসিন লিমিটেডের এমডি উত্তম কুমার মিস্ত্রি, চেয়ারম্যান অতশী মৃধা, জিঅ্যান্ডজি এন্টারপ্রাইজের মালিক গোপাল চন্দ্র গাঙ্গুলী, দ্রিনান অ্যাপারেলসের এমডি মোহাম্মদ আবু রাজিব মারুফ, কণিকা এন্টারপ্রাইজের মালিক রাম প্রসাদ রায় ও ইমেক্রো’র মালিক ইমাম হোসেন।
এ ছাড়া রয়েছেন দিয়া শিপিং লিমিটেডের পরিচালক শিব প্রসাদ ব্যানার্জি, পাপিয়া ব্যানার্জি এবং এফ এ এসের চেয়ারম্যান এমএ হাফিজ। এরা সবাই দুদকের করা মামলার আসামি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ