অনেকের কাছেই ছিলেন দুনিয়ার ‘কুৎসিততম’ নারী। তাদের হাসির খোরাক। নিষ্ঠুরতা, কটূক্তির শিকার। তবে সন্তানের মুখ চেয়ে সে সবই সয়েছেন মেরি অ্যান বিভান। এমনকি, তাদের পেট চালাতে ওই তকমা হাতিয়ার করে দিনের পর দিন সংসার টেনেছেন।
মেরি অ্যানের কাহিনি প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো। তবে তার লড়াইয়ের গল্প আজও ধূসর হয়ে যায়নি। দুরূহ অসুখে ভুগলেও তার তোয়াক্কা করেননি। বরং নিজের অসুখের জন্য ‘কুৎসিততম’ মুখকে অস্ত্র করেই জীবনযুদ্ধে শামিল হয়েছেন। প্রায় দেড়শো শতক পেরিয়ে মেরি অ্যানের গল্প আজ অনেকের কাছে প্রেরণার উৎস।
ইংল্যান্ডের নরহ্যামে এক শ্রমজীবী পরিবারে জন্মেছিলেন মেরি অ্যান। সালটা ১৮৭৪। পূর্ব লন্ডনের শহরতলি প্লেসটোতে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। ওয়েবস্টারদের পরিবারে তখন মেরি অ্যানকে মিলিয়ে আট সন্তান। ফলে কম বয়সে রোজগারপাতি শুরু করতে হয়েছিল তাকে।
সবাই বলতেন, ছিপছিপে রোগা মেয়েটির মুখখানি বেশ চোখ টানে। তবে মেরি অ্যানের সে সবের দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই। তার স্বপ্ন, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তারপর একটা বড়সড় সংসার পাতবেন। এক সময় সে সব স্বপ্নও পূরণ হয় মেরি অ্যানের। কম বয়সেই নার্সের চাকরি পেয়ে যান। ২৯ বছর বয়সে সংসারও শুরু করেন।
১৯০৩ সালে টমাস বিভানকে বিয়ে করেন মেরি অ্যান ওয়েবস্টার। তবে বিয়ের পর থেকেই নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে শুরু করেছিল। কখনও মাইগ্রেন। কখনও আবার পেশিতে বা গাঁটে ব্যথা। তবে সে সব সামলেই সংসার করছিলেন মেরি অ্যান।
শারীরিক সমস্যা সত্ত্বেও তাতে নজর দেওয়ার সময় ছিল না মেরি অ্যানের। ইতিমধ্যে চার সন্তানের মা হয়েছেন। ফলে সংসারের কাজেই সব সময় ব্যস্ত। মাইগ্রেন বা গাঁটে ব্যথার সঙ্গে এবার আরো একটি সমস্যা শুরু হয়েছিল। মুখের হাড়গোড় অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে শুরু করেছে। ফলে ধীরে ধীরে মুখ বিকৃতও হতে থাকে মেরি অ্যানের।
কম বয়সেই তার চেহারা বদলে গিয়েছিল। সংসারের চাপে নুইয়ে পড়া নারীদের তো এ রকম ‘ঘরোয়া’ চেহারাই দেখা যায়- অনেকে এমন বলেছিলেন। কী অসুখে ভুগছেন? জানতে চিকিৎসকের কাছে ছুটেছিলেন মেরি অ্যান এবং টমাস। পরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, মেরি অ্যানের অসুখের নাম ‘অ্যাক্রোমেগ্যালি’। এমন এক সমস্যা যাতে দেহে অতিরিক্ত মাত্রায় হরমোন নিঃসৃত হয়। যার জেরে হাড়গোড়, পেশি এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে পেশিতে তীব্র যন্ত্রণা এবং মাথাব্যথাও হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টিউমার থাকায় এই সমস্যা দেখা দেয়। চিৎসকেরা আরো জানিয়েছিলেন, একে পিটুউটারি অ্যাডেনোমাও বলে।
আধুনিক বিজ্ঞানে এই সমস্যাকে কাটিয়ে উঠা সম্ভব। তবে প্রায় দেড়শো বছর আগে ‘অ্যাক্রোমেগ্যালি’-র সমস্যার বিশেষ চিকিৎসা ছিল না। ফলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক মুখাবয়ব হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন মেরি অ্যান। এরই মাঝে হঠাৎই ছন্দপতন। বিয়ের ১১ বছরের মাথায় মারা যান মেরি অ্যানের স্বামী টমাস।
চার সন্তানকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েন তিনি। সংসার চালাতে আবারও রোজগারের খোঁজে নেমে পড়েন। তবে মেরি অ্যানের মুখের দিকে চেয়ে কেউ তাকে কাজ দিতে রাজি নন। উল্টে অপমান করে তাড়িয়ে দেন অথবা ঠাট্টাতামাসা করেন। দিন কাটানোই সঙ্গিন হয়ে ওঠে মেরি অ্যানের।
হঠাৎ মেরি অ্যানের নজরে পড়ে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন- দুনিয়ার ‘কুৎসিততম’ মহিলাদের খুঁজতে ইংল্যান্ডে একটি প্রতিযোগিতা হচ্ছে। তাতে জিতলে মোটা অঙ্কের অর্থপ্রাপ্তি হবে। মনস্থির করে ফেলেন মেরি অ্যান। সন্তানদের জন্য তাকে জিততেই হবে। এক সময় সে প্রতিযোগিতার খেতাবও জিতে ফেলেন মেরি অ্যান।
সংসার চালাতে এবার দুনিয়ার ‘কুৎসিততম’ নারীর খেতাবকেই হাতিয়ার করে ফেলেন মেরি অ্যান। ১৯২০ সালে আমেরিকার সার্কাসে কাজের ডাক পান মেরি অ্যান। তাবু খাটানো মঞ্চে উঠে সবাইকে হাসাতে হবে। যেমনটা সার্কাসের জোকাররা করেন। অথবা সায়ামিজ যমজ বা দৈত্যাকার মানুষদের দেখে হাসি লুঠতে ভিড় করেন মানুষজন। সঙ্গে সঙ্গে রাজি মেরি অ্যান। ইংল্যান্ডের জীবন ছেড়ে আমেরিকা পাড়ি দেন তিনি।
জাহাজে করে আমেরিকার মাটিতে পা রাখামাত্রই মেরি অ্যানকে নিয়ে হইচই শুরু হয়েছিল। নিউ ইয়র্কের বহু সংবাদপত্রে ‘দুনিয়ার কুৎসিততম মহিলা’ শিরোনামে তাকে নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সার্কাসে লোক হাসাতে নিজের চেহারাকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করেছিলেন মেরি অ্যান। সাকার্সে তাকে দেখতে ভিড় বাড়তে থাকে। দর্শকেরা তাকে দেখে হেসে লুটিয়ে পড়েছেন। তবে মেরি অ্যানের মানসিক যন্ত্রণার হদিশ পাননি তারা। সংসার চালাতে দিনের পর দিন সে যন্ত্রণা সামলেছেন মেরি অ্যান।
মেরি অ্যানকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশার বিরুদ্ধে এক সময় সরব হয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। তিনি যে ‘অ্যাক্রোমেগ্যালি’-র সমস্যায় ভুগছেন, তা কোনোভাবে প্রকাশ্যে চলে আসে। ১৯২৭ সালে সে সময়কার এক স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ হার্ভি কাসিং চিঠি লিখে প্রতিবাদ জানান। মেরি অ্যানের চেহারাকে যেভাবে হাসির খোরাক করে তোলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন হার্ভি। তবে প্রতিবাদ সত্ত্বেও সার্কাসে মেরি অ্যানের শো বন্ধ হয়নি।
সার্কাস থেকে রোজগারের অর্থে মেরি অ্যানের সংসার সচ্ছল হতে শুরু করেছিল। অনেকের দাবি, ১৯২৭ থেকে ’৩০ সাল পর্যন্ত ২০ হাজার পাউন্ড রোজগার করেছিলেন তিনি। সে সময় যা দু’লাখের টাকারও বেশি।
জনপ্রিয়তার সঙ্গে আয় বাড়লেও মেরি অ্যানকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপের মাত্রা কমেনি। তবে শেষজীবন পর্যন্ত সার্কাসের মঞ্চেই কাটিয়েছেন তিনি। কেবলমাত্র এক বার ইউরোপে ফেরার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে একটি প্রদর্শনীতে যোগ দিতে প্যারিসে গিয়েছিলেন। তবে দেশের মাটিতে আর ফেরা হয়নি। যদিও তার দেহ ফিরেছিল ইংল্যান্ডে।
‘অ্যাক্রোমেগ্যালি’-র বেশির ভাগ রোগীই দীর্ঘজীবী হন না। মেরি অ্যানও বেশি দিন বাঁচেননি। ১৯৩৩ সালে ৫৯ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তবে মৃত্যুশয্যায় সন্তানদের বলে গিয়েছিলেন, তার দেহ যেন দেশের মাটিতে সমাধিস্থ করা হয়। সে কথা রেখেছিলেন মেরি অ্যানের চার সন্তান।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ