পশ্চিমের নাঙ্গা পর্বত থেকে পূর্বের নামচা বারওয়া, প্রায় ২৪০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা হিমালয়কে ঘিরে আছে রহস্য। ‘ইয়েতি’ ও ‘রূপকুণ্ড’ রহস্য জনসমক্ষে চলে এলেও হিমালয়ের অন্তপুরে লুকিয়ে আছে এরকম অসংখ্য অজানা রহস্য।
সব বাধা পেরিয়ে এখানে কেউ যায় তুষার শৃঙ্গে আরোহণ করে নিজের শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছবার উদ্দেশ্য নিয়ে। আর একদল মানুষ সংসার ত্যাগ করে জীবনের গভীর অর্থ খুঁজে বের করার জন্য যায় হিমালয়ে। গৈরিকধারী এই মানুষগুলোর কাছে হিমালয় হলো এই গ্রহের সবচেয়ে রহস্যময় স্থান। কারণ হিমালয়ের যে অংশে মানুষের পদচিহ্ন আজও পড়েনি, সেখানেই লুকিয়ে আছে এমন সব রহস্য, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না।
হিমালয়কে ঘিরে বাস করা কয়েকটি গোষ্ঠী অত্যন্ত গোপনে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বয়ে নিয়ে চলেছেন এই রহস্যের মশাল, যার নাম শাম্ভালা বা জ্ঞানগঞ্জ। এই রহস্য ভেদ করা আজও সম্ভব হয়নি।
জ্ঞানগঞ্জ হলো হিমালয়ের দুর্গম স্থানে লুকিয়ে থাকা এক রহস্যময় নগররাষ্ট্র। তিব্বতে এই নগররাষ্ট্রটিকে বলা হয়ে শাম্বালা। ভারতে বলা হয় জ্ঞানগঞ্জ বা সিদ্ধাশ্রম। এই নগররাষ্ট্রে প্রবেশ করার অধিকার সাধারণ মানুষের নেই। কারণ জ্ঞানগঞ্জ হল অমরলোক। এখানে কারো মৃত্যু হয় না। চেতনা এখানে সদা জাগ্রত থাকে।
কথিত আছে, যারা জীবনে একটিও পাপ করেননি, কেবলমাত্র সেইসব সিদ্ধপুরুষরাই সর্বোচ্চ জ্ঞানলাভ করার জন্য এই আধ্যাত্মিক নগরীতে প্রবেশ করতে পারেন। কারণ, জ্ঞানগঞ্জে লুকিয়ে রাখা আছে এই গ্রহের সর্বোচ্চ জ্ঞান। যে জ্ঞান পৃথিবীর ভাগ্য নির্ধারণ করে।
জ্ঞানগঞ্জের সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। হিমালয়ের এক গোপনস্থানে, সিদ্ধ-হ্রদ নামে একটি সুবিশাল হ্রদকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছে এই নগররাষ্ট্রটি। জ্ঞানগঞ্জের সুদৃশ্য বাড়ি ও প্রাসাদগুলো বর্ণময় পাথর দিয়ে তৈরি। বাড়ি ও প্রাসাদের দেয়ালগুলোতে খোদাই করা আছে জ্ঞানগঞ্জের প্রতীক। যে প্রতীকে দেখতে পাওয়া যাবে আট পাপড়ি যুক্ত একটি পবিত্র পদ্মফুলকে। পদ্মটিকে ঘিরে আছে তুষারাচ্ছাদিত পর্বতমালা। পদ্মের মাঝখানে ঝলমল করছে অতীব উজ্জ্বল একটি স্ফটিক।
দিনের বিভিন্ন সময় বদলে যায় জ্ঞানগঞ্জের পরিবেশ। গিরগিটি যেমন বিপদের আশঙ্কায় রূপ বদলে প্রকৃতিতে মিশে যায়। ঠিক সেরকমভাবেই হিমালয়ের বুকে প্রকৃতির রঙের মধ্যে হারিয়ে যায় জ্ঞানগঞ্জ। তাই ধরা পড়ে না সাধারণ চোখে। তাই নগররাষ্ট্রটির অবস্থান সম্পর্কেও কারো কোনো ধারণা নেই।
বারবার রূপ বদলানোর ফলে জ্ঞানগঞ্জের হদিশ নাকি দিতে পারছে না বিজ্ঞানও। সত্যিই হিমালয়ে এরকম কোনো নগররাষ্ট্রের ধ্বংসাবশেষও খুঁজে পায়নি স্যাটেলাইট। অথচ অসংখ্য হিন্দু ও বৌদ্ধ পুরাণে হিমালয়ে লুকিয়ে থাকা এই নগররাষ্ট্রটির উল্লেখ আছে।
হিন্দু বা সনাতন ধর্মে জ্ঞানগঞ্জের নাম ‘সিদ্ধাশ্রম’। সিদ্ধপুরুষদের নির্জন আবাস হলো ‘সিদ্ধাশ্রম’। সিদ্ধাশ্রমের কথা বলা হয়েছে চতুর্বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারতসহ বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথিতে। হিমালয়ের অন্দরে লুকিয়ে থাকা এই নগররাষ্ট্রটিকে বৌদ্ধধর্মে বলা হয়েছে ‘শাম্ভালা’। শাম্ভালার উল্লেখ আছে বৌদ্ধ ধর্মের ‘কালচক্র’ তন্ত্র ও সুপ্রাচীন তিব্বতীয় পুঁথি ঝাংজুং-এও।
তিব্বতীয় বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন রহস্যময় শাম্ভালা লুকিয়ে আছে ট্রান্স-হিমালয়ের কোনো দুর্গম জায়গায়। পৃথিবীর যখন ভয়ঙ্কর দুঃসময় আসবে, নীল পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করবেন শাম্ভালার ২৫ তম শাসক। ঔপন্যাসিক জেমস হিলটন শাম্ভালার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে লিখে ফেলেছিলেন ‘Lost Horizon, about the lost kingdom of Shangri-La’ নামের উপন্যাসটি। হিমালয়ের রহস্যময় নগররাষ্ট্র শাম্ভালা, তার উপন্যাসে হয়ে গিয়েছিল শাংগ্রিলা, যাতে তিব্বতীদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত না লাগে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই জ্ঞানগঞ্জের খোঁজ করে চলেছিলেন হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের সিদ্ধপুরুষরা, যারা জ্ঞানগঞ্জ যাওয়ার আমন্ত্রণ পাননি। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের দরবারের শাস্ত্রজ্ঞদের কাছ থেকে জ্ঞানগঞ্জের কথা জানতে পেরেছিলেন ইউরোপীয় ভূপর্যটকেরাও। তারাও সন্ধান শুরু করেছিলেন। কিন্তু কেউই খুঁজে পাননি জ্ঞানগঞ্জ। কেবল অনুমানের তির নিক্ষেপ করেছিলেন হিমালয়ের বিভিন্ন এলাকায়।
কেউ বলেছিলেন জ্ঞানগঞ্জ লুকিয়ে আছে তিব্বতের কৈলাস পর্বতের কাছে থাকা এক গোপন উপত্যকায়। কেউ বলেছিলেন জ্ঞানগঞ্জ লুকিয়ে কাশ্মীর হিমালয়ে। কেউ বলেছিলেন ভারত ও চিন সীমান্তে অবস্থিত ছাং-চেমনো রেঞ্জের কঙ্গকা গিরিপথের কাছেই লুকিয়ে আছে জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্বালা।
আধুনিক যুগেও বহু অভিযাত্রী ‘ইয়েতি রহস্য’ ভেদ করার মতোই ‘জ্ঞানগঞ্জ’ রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারাও সফল হননি। অথচ বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন পুঁথিতে জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালায় যাওয়ার পথনির্দেশ দেওয়া আছে। কিন্তু সাংকেতিক ভাষার মর্মোদ্ধার করা আজ অবধি সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি। মাত্র কয়েকজন উচ্চকোটির সাধক সেই সাংকেতিক ভাষার রহস্যভেদ করে অতি গোপনে পৌঁছে যান জ্ঞানগঞ্জ।
১৮৩৩ সালে হাঙ্গেরির গবেষক সিসোমা ডি কোরোস গবেষণা শুরু করেছিলেন জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালাকে নিয়ে। বছরের পর বছর তিব্বতে কাটালেও রহস্য ভেদ করতে পারেননি। এরপর জ্ঞানগঞ্জ রহস্যভেদ করতে ভারতে এসেছিলেন রাশিয়ার বিতর্কিত দার্শনিক ও রহস্যসন্ধানী মাদাম ব্লাভাটস্কি। রহস্যভেদ না করতে পারলেও রহস্যের আগুনে ইন্ধন দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন শাম্ভালা বা জ্ঞানগঞ্জ আসলে লুমেরিয়া ও অ্যাটলান্টিসের মতোই মায়াবী। তাকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। কারণ নগরটি নিজে থেকে ধরা দিতে চায় না।
জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালার ওপর গবেষণা করেছিলেন রাশিয়ার প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক, প্রত্নতাত্ত্বিক, চিত্রশিল্পী, ধর্মতত্ত্ববিদ নিকোলাই রোয়েরিখ। তার মনে হয়েছিল জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালা লুকিয়ে আছে, মঙ্গোলিয়া ও তিব্বতের মাঝে থাকা আলতাই পর্বতশ্রেণির মধ্যে। ১৯২০ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ অভিযান চালিয়েছিলেন সেই এলাকায়। কিন্তু তিনিও খুঁজে পাননি জ্ঞানগঞ্জ। তবে অভিযান চলার সময় একটি অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন। আলতাই পর্বতশ্রেণির দুর্গম উপত্যকায় একদিন সকালে রোয়েরিখ দেখেছিলেন এক অদ্ভুত দৃশ্য।
ডাইরিতে লিখেছিলেন, ‘উজ্জ্বল সূর্যের মতো আলো ছড়াতে ছড়াতে বিশালকায় ডিমের মতো একটা বস্তু আকাশপথে ছুটে গেল উন্মত্ত গতিতে। আমাদের ক্যাম্প পেরিয়ে গেল। গতিপথ পরিবর্তন করে দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ-পূর্বে চলে গেল। আমরা দেখলাম কীভাবে সেটা নীল আকাশে হারিয়ে গেল। তবে আমরা দূরবীণ বের করে বস্তুটির ডিম্বাকার আকৃতি ও সূর্যের মতোই উজ্জ্বল দেহটি দেখার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিলাম।’
পরবর্তীকালে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কী দেখেছিলেন নিকোলাই রোয়েরিখ! তখনও ভিনগ্রহের জীবদের মহাকাশ যান বা ইউএফও নিয়ে আলোচনাই শুরু হয়নি পৃথিবীতে। তাহলে বিশালকায় ডিমের মতো বস্তুটি কী! পুঁথি থেকে জানা গেছে জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালা রূপ পরিবর্তন করে। তাহলে কী স্থানও পরিবর্তন করে জ্ঞানগঞ্জ! তাই তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না!
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪৫
আপনার মতামত জানানঃ