ইউক্রেনের পশ্চিমে ডনবাস অঞ্চলে দেশটির সরকারি বাহিনী এবং রাশিয়া সমর্থিত বিদ্রোহীদের মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও লড়াই অব্যাহত ছিল। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর গোলার আঘাতে দেশটির পূর্বাঞ্চলে রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় ২ জন বেসামরিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম আরআইএ নিউজ এজেন্সির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
গত প্রায় এক দশক ধরে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বিশাল এলাকা রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে আছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সেই এলাকাকে পৃথক একটি দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেই দেশের নাম লুহানস্ক পিপল’স রিপাবলিক। যদিও, কিয়েভ এই দেশের অস্তিত্ব কখনও মেনে নেয়নি।
আট বছর আগে কিয়েভ এবং ইউক্রেনের রুশ বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়; কিন্তু গত দুই মাস ধরে ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় দুই লাখ রুশ সেনার উপস্থিতির জেরে ফের দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয়েছে উত্তেজনা। গত কয়েকদিন ধরে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে সংঘাত শুরু হয়েছে। মর্টার, গোলাসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ও রুশ বিদ্রোহীরা; এবং উভয়পক্ষই যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘণের জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করছে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার এই চলমান উত্তেজনার সূত্রপাত সেই ২০১৪ সালে যখন ইউক্রেনে রুশ-পন্থী প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, রাশিয়া সৈন্য পাঠিয়ে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় ক্রাইমিয়া দখল করে নেয়। একই সময়ে রাশিয়ার সাহায্যে জাতিগত রুশ বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বড় একটি এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তখন থেকেই বিদ্রোহীদের সাথে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর থেকে থেকে লড়াই চলছে যাতে ১৪ হাজারেরও বেশি লোক মারা গেছে। দু পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হলেও একে অপরের প্রতি তা ভঙ্গ করার অভিযোগ রয়েছে।
রাশিয়া মূলত কী চায়?
রাশিয়া কি সত্যিই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে- এটিই এখন সবথেকে বড় প্রশ্ন। যদিও রাশিয়া বার বার জোর গলায় এমন কোন পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করছে যে তারা ইউক্রেনে একটি যুদ্ধ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তবে রাশিয়া আগেও ইউক্রেনের সীমানা দখল করেছে। এই মূহুর্তে তাদের প্রায় এক লাখ সৈন্য ইউক্রেনের সীমান্তের কাছে মোতায়েন আছে বলে মনে করা হচ্ছে। রাশিয়া বহুদিন ধরেই চেষ্টা করছে, ইউক্রেন যাতে কোনভাবেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে না যায়।
তাদের আরও আপত্তি নেটো জোট নিয়ে। ইউক্রেন এখনও নেটো জোটের সদস্য নয়। কিন্তু পূর্ব ইউরোপের আরও অনেক সাবেক কমিউনিস্ট দেশের মতো, ইউক্রেনও সেই পথে চলেছে বলে মনে করছে রাশিয়া।
এই মূহুর্তে সেখানে তীব্র সামরিক উত্তেজনা রয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে পশ্চিমা দেশগুলো যদি তাদের আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি না বদলায়, তাহলে “যথাযথ পাল্টা সামরিক-কারিগরি’ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নেটোর সেক্রেটারি জেনারেল মনে করেন, একটা সংঘাতের বাস্তব সম্ভাবনা আছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বাস করেন, রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, রাশিয়া কেন ইউক্রেন সীমান্তের কাছে এত সৈন্য পাঠিয়েছে, তার কোন ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। বেলারুশেও রাশিয়ার সৈন্যরা যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা, রাশিয়া এ বছরের প্রথম ভাগেই কোন এক সময়ে ইউক্রেনে ঢুকবে।
রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বর্তমান সংকটকে কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৯৬২ সালের সেই সংকটের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায় একটি পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র কী চাইছে?
ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সংকট মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোকে ঘিরে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য ও রাশিয়ার প্রতিবেশীরাষ্ট্র ইউক্রেন কয়েক বছর আগে ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করার পর থেকেই সংকট শুরু হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে। সম্প্রতি ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্যপদ না দিলেও ‘সহযোগী দেশ’ হিসেবে মনোনীত করার পর আরও বেড়েছে এই উত্তেজনা।
ইউক্রেন এখনও নেটোর সদস্য নয়। তবে তাদের সঙ্গে নেটোর সখ্যতা আছে। ভবিষ্যতে কোন একদিন তারা নেটো জোটের সদস্য হবে, এরকম একটা বোঝাপড়া আছে। তবে রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে এরকম একটা নিশ্চয়তা চায়, যেন এটা কখনওই না ঘটে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো এরকম নিশ্চয়তা দিতে রাজী নয়।
ইউক্রেনের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ জাতিগতভাবে রুশ। তাদের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আছে। রাশিয়া কৌশলগতভাবে ইউক্রেনকে তার বাড়ির পেছনের আঙ্গিনা বলে বিবেচনা করে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন, পশ্চিমা শক্তি আসলে নেটো জোটকে ব্যবহার করে চারিদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলছে। তিনি চান নেটো যেন পূর্ব ইউরোপে তাদের সামরিক তৎপরতা কমিয়ে আনে। তিনি বহুদিন ধরে অভিযোগ করে যাচ্ছেন যে ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেটো জোটকে পূর্বদিকে সম্প্রসারণ করা হবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটি তারা রাখেনি। তবে নেটো রাশিয়ার এই কথা প্রত্যাখ্যান করেছে।
এ পরিস্থিতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, রাশিয়া যে কোন সময় ইউক্রেন দখল করে নেবে বলে তিনি মনে করেন। বেলারুশে রাশিয়ার সৈন্য মোতায়েন এবং মহড়া অব্যাহত রাখা তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
তিনি বলেছেন, চলমান উত্তেজনার মধ্যেই ইউক্রেনের পাশে বেলারুশে তিরিশ হাজার সৈন্য মোতায়েন রাখার ব্যাপারে মস্কোর সিদ্ধান্ত এমন সঙ্কেত দেয়।
ইউক্রেন দখল করে নেবার ব্যাপারে রাশিয়ান সেনা কমান্ডারদের আদেশ দেয়া হয়েছে বলে অজ্ঞাতনামা এক মার্কিন গোয়েন্দার তরফ থেকে তথ্য পাওয়ার পর এমন বক্তব্য দিলেন অ্যান্টনি ব্লিংকেন।
তবে ইউক্রেন বলছেন, আসন্ন হামলা সম্পর্কে এমন বক্তব্য ‘অসমীচীন’। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেক্সি রেজনিকভ বলেছেন, কাল অথবা পরশু’র মধ্যেই হামলা হবে এমন কোন লক্ষণ নেই কারণ রাশিয়া এখনো সীমান্তে কোন ‘স্ট্রাইক গ্রুপস’ বা হামলা দল তৈরি করেনি।
এদিকে ইউক্রেন দখল করে নেয়ার চেষ্টা সম্পর্কিত এসব দাবি অস্বীকার করে আসছে প্রতিবেশী রাশিয়া। অভিযানের আশংকার মধ্যেই বেলারুশ বলেছে রুশ সৈন্যদের সাথে তাদের যে যৌথ সামরিক মহড়া চলছিল, সেটির মেয়াদ বাড়ানোর কারণ ইউক্রেনে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।
সিবিসি নিউজ এক প্রতিবেদনে বলছে, আক্রমণের আদেশ পাওয়ার পর রুশ কমান্ডারেরা কিভাবে হামলা চালাবে তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ইউক্রেনে হামলা শুরু হবে সাইবার আক্রমণ দিয়ে। তারপর স্থল বাহিনী রাজধানী কিয়েভ দখল করে নেয়ার আগে মিসাইল ও বিমান হামলা চালানো হবে।
অজ্ঞাতনামা মার্কিন গোয়েন্দা সিএনএনকে বলেছে, রাশিয়ান সেনাবাহিনীর অন্তত সত্তর শতাংশ এখন ইউক্রেন সীমান্তে অবস্থান করছে। হামলা করা যায় এমন দূরত্বে তারা অবস্থান করছে যা খুবই অস্বাভাবিক।
মার্কিন স্যাটেলাইট কোম্পানি ম্যাক্সার স্যাটেলাইটে ধারণ করা নতুন ছবি প্রকাশ করেছে। রাশিয়ান গ্যারিসন থেকে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে নতুন করে সেনা ও ভারি অস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছে বলে তাতে দেখা যাচ্ছে। এতে করে হামলার জন্য রুশ বাহিনী কতটা প্রস্তুত তার ধারণা পাওয়া যায়, এমনটাই দাবি করছে ম্যাক্সার।
অব্যাহত উত্তেজনার মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁর মধ্যে আবারও ফোনে কথাবার্তা হয়েছে। তাদের মধ্যে পূর্ব ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। পুতিন ডনবাস এলাকায় উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ