ঢাকা ওয়াসার প্রকল্পভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলমান ১০টি প্রকল্পের মধ্যে ৮টিই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। এই প্রকল্পগুলোর অনুমোদিত খরচের বাইরে আরও ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। আট প্রকল্পের চারটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। চারটির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বাকি দুটি প্রকল্পের একটি ২০২৩, অন্যটি ২০২৪ সালে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এগুলোর একটির কাজ ২৩ ভাগ এবং আরেকটির মাত্র ৭ ভাগ হয়েছে। এই ১০ প্রকল্পের মোট ব্যয় ২৬ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা।
ওয়াসার বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো পরিশোধনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ, পয়োবর্জ্য পরিশোধন এবং জলাবদ্ধতা নিরসন–সংশ্লিষ্ট। যথাসময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায় যে উদ্দেশ্যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তার পূর্ণ সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কমছে। কারণ সময়, চাহিদা সব বদলে যাচ্ছে। ওয়াসার ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পানি সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হচ্ছে না। জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থ হওয়ায় ওয়াসার কাছ থেকে নিয়ে এই দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়েছে।
নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর নতুন একটি ধারা তৈরি হয়েছে। এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না। তিনি বলেন, প্রকল্প নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই সঠিকভাবে করতে হবে। অনুমোদনের পর প্রকল্পের খরচ আর বাড়ানো যাবে না—সরকারের এখনই এমন নিয়ম চালু করা উচিত।
ওয়াসার প্রকল্পের মতো বাড়ছে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) মেয়াদও। দীর্ঘ ১১ বছর ধরে দায়িত্বে রয়েছেন তাকসিম এ খান। নাগরিক সেবার মান নিয়ে তীব্র সমালোচনা ও নানা বিতর্কের মুখে পড়লেও ওয়াসার এমডি পদে দফায় দফায় নিয়োগ পাচ্ছেন তিনি।
ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির ৬৫ ভাগই আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে প্রতিবছর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন করে ঢাকায় আনার জন্য একটি প্রকল্প নেয় ওয়াসা।
মূলত প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পানি সরবরাহ বাড়াতে। কিন্তু ৯ বছর আগে নেওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ দুই দফায় বাড়ানোর সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে যায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ফল হচ্ছে এখন পর্যন্ত অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি।
মেঘনা নদীর পানি শোধনের জন্য নেওয়া ঢাকা ওয়াসার নেওয়া এ প্রকল্পের নাম ‘ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই’। তবে প্রকল্পটি ‘গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্প’ নামে বেশি পরিচিত। প্রকল্পটির কাজ শুরু করে ২০১৩ সালের অক্টোবরে। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
কাজ শেষ না হওয়ায় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ এক দফা বাড়ানো হয়। সংশোধিত প্রকল্পে ২ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এটি এখন ৮ হাজার ১৫১ কোটি টাকার প্রকল্প। নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফা ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে এখনই সংশয় তৈরি হয়েছে।
প্রকল্পের এমন দীর্ঘসূত্রতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রকল্পের প্রাথমিক সরবরাহ লাইন তৈরির জন্য ঠিকাদার চূড়ান্ত করতেই লেগেছে ২ বছর ৯ মাস। বাস্তব কাজ দরপত্র চূড়ান্ত করার চেয়েও কঠিন। বাকি কাজ শেষ হবে কত দিনে, পাঁচ-ছয় বছরে? প্রকল্প তো নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে না। আগের অভিজ্ঞতা বলে, কাজের সময় বাড়লে প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়বে।
শুধু গন্ধর্বপুর প্রকল্প নয়, ঢাকা ওয়াসার বাস্তবায়নাধীন অধিকাংশ প্রকল্পই নির্ধারিত সময় ও খরচে শেষ হচ্ছে না। ওয়াসার প্রকল্পভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওয়াসার চলমান ৮টি প্রকল্পের মধ্যে ৬টিই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। এ প্রকল্পগুলোর অনুমোদিত খরচের বাইরে আরও প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।
সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্পের (ফেজ–৩) ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। একাধিকবার মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ৩৯৫ কোটি টাকা।
বারবার সময় বাড়িয়েও কাজ শেষ করতে না পারার পেছনে ওয়াসার একাধিক প্রকৌশলী নাম না প্রকাশের শর্তে বলছেন, প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে এমনটি হচ্ছে। একটি নির্ধারিত অঙ্কের টাকায় প্রকল্প অনুমোদন করানোর পরে খেয়ালখুশিমতো কাজ করে যেকোনোভাবে সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে।
গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের মেঘনা নদীর বিষনন্দী পয়েন্ট থেকে পানি আনা হবে সিদ্ধিরগঞ্জের গন্ধর্বপুর এলাকায় নির্মাণাধীন শোধনাগারে। সেখানে পানি শোধন করে পাইপলাইনের মাধ্যমে তা রাজধানীর বাসায় বাসায় সরবরাহ করা হবে। দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি আসার কথা এ প্রকল্প থেকে।
প্রকল্প সূত্র জানায়, একাধিক ভাগে (প্যাকেজ) পুরো প্রকল্পের কাজ হবে। বারিধারা থেকে রামপুরা এবং বারিধারা থেকে এয়ারপোর্ট রোড, উত্তরা, গুলশান, বনানী ও কচুক্ষেত এলাকায় পানি সরবরাহে ২৫ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হবে। লাইন নির্মাণে গত সেপ্টেম্বর মাসে চীনা এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে ওয়াসা। এ চুক্তির মেয়াদ তিন বছর। মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করতে আগামী জুন মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গন্ধর্বপুরে পানি শোধনাগারের পরিশোধিত পানি রাজধানীতে আনতে ঢাকার বারিধারা-ভাটারা ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণ করা হবে। ১ হাজার ৬০০ মিলিমিটার ব্যাসের প্রায় ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ লাইনের নির্মাণকাজ প্রক্রিয়া মাত্র শুরু হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন প্রকৌশলী বলেন, সংশোধিত সময়েও প্রকল্পের কাজ শেষ করা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। জমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত জটিলতাই এখনো কাটেনি। সরবরাহ লাইনের জন্য রাস্তা খননের অনুমতি পাওয়া এবং অন্যান্য সেবা সংস্থার সংযোগ সরিয়ে কাজ করতে হবে। এতে প্রকল্পের ব্যয় ও সময় আরেক দফা বাড়তে পারে।
ওয়াসার উপপ্রধান জন তথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক জানান, গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৪৮ শতাংশ। জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ পর্যায়ে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করতে ওয়াসা কাজ করছে।
এ প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে ওয়াসা ৯টি কারণ উল্লেখ করেছে। তার মধ্যে জমি অধিগ্রহণের খরচ বেড়ে যাওয়া, প্রকল্পে নতুন প্যাকেজ যুক্ত হওয়া, মুদ্রাস্ফীতি, রাস্তা খনন ফি বৃদ্ধি এবং করোনা মহামারির কারণে কাজের গতি কমে যাওয়া অন্যতম। প্রকল্পের ব্যয় আবারও বাড়বে কি না, এমন প্রশ্নে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলেছে, পানির লাইন স্থাপনে মাটির নিচের কাজ এবং অন্যান্য সেবা সংস্থার সংযোগ থাকায় ব্যয় বাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা কঠিন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তেও ওয়াসার প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি উঠে এসেছে। ওয়াসার বিষয়ে দুদকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না করে বিভিন্ন অজুহাতে ওয়াসার প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ও ব্যয় বাড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট থাকে।
নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, প্রকল্প নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই হয় না, সংশ্লিষ্টদের প্রকল্প সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাই থাকে না। অনুমোদনের পর প্রকল্পের খরচ আর বাড়ানো যাবে না; সরকারের এমন নিয়ম চালু করা উচিত। ঢাকা ওয়াসার প্রকল্পের দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়ানোর বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫৭
আপনার মতামত জানানঃ