গত বছরের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে নারীদের ওপর একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করে যাচ্ছে তালেবান। গোষ্ঠীটির এসব নিষেধাজ্ঞায় নারীদের অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে দাবি করা হয়ে থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় আফগান নারীদের হিজাব পরার আহ্বান জানিয়ে রাজধানী কাবুলে ব্যানার টানিয়েছে আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালেবান। রোববার (৯ জানুয়ারি) দেশটির সৎ কর্মে আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজধানী কাবুলজুড়ে দেয়াল ও গাছে এই ব্যানার ও প্লাকার্ড টানিয়ে দেয়।
সোমবার (১০ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে আফগান বার্তাসংস্থা খ্যামা প্রেস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীদের বোরকা ও হিজাব পরতে রাজধানী শহরজুড়ে ব্যানার টাঙানোর পাশাপাশি সমগ্র আফগানিস্তানের গাড়ি চালকদের প্রতিও নতুন নির্দেশনা দিয়েছে তালেবান।
এই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, হিজাব না পরলে কোনো নারীকে গাড়িতে আসন দেওয়া যাবে না। বার্তাসংস্থা খ্যামা প্রেস বলছে, রোববার (৯ জানুয়ারি) আফগান রাজধানী কাবুলে নারীদের হিজাব পরার আহ্বান সম্বলিত ব্যানার ও প্লাকার্ডগুলো প্রথম দেখা যায়।
এই ব্যানারে মেয়েদের বোরকা পরিহিত দু’টি ছবিও দেওয়া হয়েছে। এর একটিতে কালো রংয়ের আবায়া পরিহিত ছবিতে চোখসহ পুরো মুখমণ্ডল ঢেকে রাখার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। এবং অন্যটিতে পুরো শরীর বোরকায় ঢেকে রাখার দৃশ্য উঠে এসেছে।
ব্যানারে দেওয়া নোটিশে লেখা রয়েছে, শরীয়াহ আইন অনুযায়ী, একজন মুসলিম নারীকে অবশ্যই হিজাব পরতে হবে। কারণ এটিই শরীয়াহ আইনের নির্দেশ।
আফগানিস্তানের সৎ কর্মে আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যানার ও পোস্টার টাঙানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে হিজাব পরতে নারীদের উদ্বুদ্ধ করা। অবশ্য ব্যানারে হিজাবের বিষয়ে সুপারিশ করা হলেও সেটি পরতে নারীদের কেউ বাধ্য করতে পারবে না।
কাবুলের ক্ষমতা দখলের পর গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমে নারীদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন এক তালেবান নেতা। সেসময় ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে তিনি বলেছিলেন, হিজাব না পরা নারীদের ‘কাটা তরমুজ’-এর মতো দেখা যায়।
তার ভাষায়, ‘আপনারা কি কেউ কাটা তরমুজ ক্রয় করেন? নাকি পুরো একটি তরমুজ কেনেন? অবশ্যই পুরোটাই কেনেন। হিজাব না পরা মেয়েরা হলো ‘কাটা তরমুজ’।’
ক্ষমতা দখলের পর তালেবান অবশ্য আফগান নারীদের পূর্ণ সম্মান দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। এমনকি নারীদের পড়াশোনা এবং কাজের সুযোগও দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিল গোষ্ঠীটি। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে তালেবানকে ততই পুরনো রূপে ফিরতে দেখা যাচ্ছে।
আফগান নারীদের উত্থান-পতন
আফগানিস্তানে নারীদের বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে ১৯৯৬ সালে তালিবান প্রথম আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করার আগে কেমন ছিল আফগান নারীদের জীবন? অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক উইলিয়াম পোডলিচ ১৯৬৭ সালে ইউনেসকোর এক প্রকল্পের আওতায় দুই বছরের জন্য কাবুলের টিচার্স কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছিলেন শৌখিন আলোকচিত্রী। পোডলিচের তোলা ছবিগুলোয় তালিবানের ক্ষমতা দখলের আগের আফগান নারীদের জীবনযাত্রার আন্দাজ মেলে। সে সময়ের আফগান নারীরা পাশ্চাত্য পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন। নারী-পুরুষ একসঙ্গে বাসে যাতায়াত করতেন এবং শপিং মলে যেতেন। স্কুল-কলেজে নারীদের পড়াশোনা, গানবাজনা, খেলাধুলার ছবিও উঠে এসেছে পোডলিচের ক্যামেরায়।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালিবান শাসনামলে নারীদের জীবনযাপন বদলে যায়। ১৯৯৯ সালে তালিবান শাসনামলে থাকা এক নারীর বর্ণনায় উঠে আসে তাদের সে সময়ের কষ্টের জীবনের কথা। ফিব্রা নামের সেই নারীর বয়স এখন ৩২ বছর। থাকেন লন্ডনে। ১৯৯৯ সাল ছিল ফিব্রার শৈশবকাল। ফিব্রারা ছিলেন চার বোন ও এক ভাই। ফিব্রার বাবাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তালিবান। বাবাকে তারা আর ফিরে পাননি।
তালিবান শাসনামলে তাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাবার খোঁজ করার সময় মাকেও মারধর ও হুমকি-ধমকি দেয় তালিবান। তালিবান শাসনের পতনের পর ফিব্রাদের পড়াশোনা আবার শুরু হয়। দুই দশক পর তালিবান ফিরে আসায় আফগানিস্তানে থাকা পরিবার নিয়ে এখন আবার উদ্বেগে রয়েছেন ফিব্রা।
২০০১ সালে তালিবান সরকারের পতনের পর নারীদের জীবনে আবারও বদল আসে। শুরু হয় নতুন পথচলা। নারীরা আবার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কর্মক্ষেত্রে বাড়ে নারীদের পদচারণ। সংগীত, চিত্রাঙ্কন ও খেলাধুলায় সাফল্যের ছাপ রাখতে শুরু করেন নারীরা। গণমাধ্যমেও নারীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি বাড়ে। ইউনেসকোর তথ্য অনুসারে, গত বছর আফগানিস্তানে শিক্ষার হার ছিল ৪৩। ২০১৭ সাল থেকে পরের দুই বছরে দেশটিতে শিক্ষার হার বেড়েছে ৮।
তালিবানের ক্ষমতা দখলের পরে দেশটির অর্থনীতি, কূটনীতি, শাসনপদ্ধতি, পররাষ্ট্রনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ দেখা দেয় আফগান নারীদের নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দেশ ও সংস্থা নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আর সেসব উদ্বেগ যে অমূলক নয়, তার প্রমাণও মিলতে শুরু করেছে। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তালিবানের অন্তর্বর্তী সরকারের বেঁধে দেওয়া নানা নিয়মের বেড়াজালে আটকে পড়ছেন আফগান নারীরা।
তালিবানের নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় কোনো নারী সদস্য রাখা হয়নি। এমনকি নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভবনে নারী কর্মীদের ঢুকতে দিচ্ছে না তালিবান। তালিবান সরকারের নতুন শিক্ষামন্ত্রী আবদুল বাকি হাক্কানি আফগান নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পড়ার কথা জানিয়েছেন। শর্ত হলো তাদের হিজাব পরতে হবে। পুরুষদের সঙ্গে ক্লাস করার অনুমতি দেওয়া হয়নি নারীদের। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আলাদা ক্লাসের ও নারী শিক্ষকের বন্দোবস্ত করা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
তালিবান-নিযুক্ত আফগানিস্তানের খেলাধুলা ও শারীরিক শিক্ষাবিষয়ক দপ্তরের মহাপরিচালক জানান, দেশটিতে ৪০০ ধরনের খেলাধুলার অনুমোদন দেওয়া হবে। তবে এসব খেলায় নারীরা অংশ নিতে পারবেন কি না, তা স্পষ্ট করে জানাননি তিনি। এর মধ্যেই আফগানিস্তানের নারীদের ফুটবল দলের ৮০ জনের বেশি সদস্য পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছেন। ১৫ আগস্ট তালিবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগে কাবুল বিমানবন্দরে কাজ করতেন ৮০ জনের বেশি নারী। তবে এখন কাজে ফিরেছেন মাত্র ১২ জন।
এসডব্লিউ/এসএস/১২০৫
আপনার মতামত জানানঃ