কিশোরগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ব্যবসায়ী হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত জাকির হোসেনকে আটক করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাতে নরসিংদীর একটি মসজিদে তাবলিগের চিল্লারত অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। আটক জাকির কিশোরগঞ্জের একটি মসজিদে মুয়াজ্জিন ছিলেন। ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তাকে হত্যার পর ছয় লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
বুধবার (২২ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয় জাকির হোসেনকে
খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ৩ অক্টোবর সকালে কিশোরগঞ্জ মডেল থানাধীন কাটবাড়িয়া ডাউকিয়া মসজিদের দক্ষিণ পাশে অচেতন অবস্থায় গুরুতর জখম অজ্ঞাত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
এসময় নিহতের পাঞ্জাবির পকেটে থাকা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে পুলিশ তার নাম জানতে পারে। ঘটনার পর নিহতের ছেলে বাদী হয়ে কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। ক্লুলেস এ হত্যার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযুক্তদের গ্রেফতারে তৎপরতা শুরু করে।
পরে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৪ এর একটি দল হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তকে শনাক্ত করে। গতকাল রাতে তাকে একটি মসজিদে চিল্লারত অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়।
যেভাবে হত্যা করা হয় রমিজ উদ্দিনকে
নিহত রমিজ উদ্দিন ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মালেয়েশিয়াপ্রবাসী ছিলেন। পরে তিনি গরু ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা ও খামার ব্যবসা শুরু করেন। এসময় তার সঙ্গে স্থানীয় মসজিদের ইমামের পরিচয় হয়। তখনই তাদের মধ্যে ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান হতো।
রমিজের কাছে নগদ অর্থ আছে তা হাতিয়ে নিতেই ছক আঁকতে থাকেন মুয়াজ্জিন জাকির। এরই এক পর্যায়ে নেত্রকোনা থেকে কম দামে গরু কিনে দেওয়ার কথা বলে নির্জন জায়গায় নিয়ে হত্যা করে।
ব্যবসায়ী রমিজকে হত্যার পর তার কাছে থাকা ছয় লাখ টাকা হাতিয়ে নেন জাকির। এরপর বিভিন্ন জায়গায় তিনি আত্মগোপন করেন। হাতিয়ে নেওয়া টাকার মধ্যে এক লাখ টাকা তিনি (রমিজ) বিভিন্ন জায়গায় খরচ করেন।
গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৪ এর অভিযানে গতকাল রাতে লক্ষ্মীপুর জেলার একটি মসজিদে চিল্লারত অবস্থায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়।
জাকির পাঁচ বছর আগে নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার একটি গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
জানা যায়, নিহতের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় মুয়াজ্জিন তাকে বলেন, নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী গ্রামে কম দামে গরু পাওয়া যায়। কম দামে ক্রয়-বিক্রয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে ঘটনার ১০-১২ দিন আগে নিহত রমিজ উদ্দিনকে গরু ক্রয়-বিক্রয়ের জায়গায় নিয়ে যান তিনি। এতে ভিকটিম (রমিজ) আশ্বস্ত হন।
পরবর্তীতে ৩০ সেপ্টেম্বর ব্যাংক থেকে ছয় লাখ টাকা উত্তোলন করেন। ২ অক্টোবর রাতে রমিজকে নিয়ে প্রথমে মনোহরদী থেকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী এবং পরে বড়পুল এলাকায় যান জাকির। সেখান থেকে রিকশায় কাটাবাড়িয়া ডাউকিয়া মসজিদ এলাকার নির্জন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়িতে গরু আসবে এ কারণে তারা সেখানে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করতে থাকেন।
রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে রমিজ উদ্দিনকে কৌশলে ডাউরিয়া মসজিদের দক্ষিণ পাশে কলাবাগানে নিয়ে যান। এসময় মুয়াজ্জিন জাকির হোসেন তার সঙ্গে থাকা হাতুড়ি দিয়ে পেছন থেকে আঘাত করেন। হাতুড়ির আঘাতে রমিজ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার কপাল, মুখ, বাম চোখের ওপর ও মাথার বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করা হয়। এরপর রমিজকে মৃত ভেবে ওই জায়গা থেকে পালিয়ে যান।
র্যাব জানায়, হত্যার ঘটনার প্রায় দুই মাস আগে ভিকটিমকে হত্যা করে টাকা লুটের পরিকল্পনা করেছিলেন জাকির। হত্যার উদ্দেশ্যে ঘটনার দিন ছোট একটি ব্যাগে হাতুড়ি বহন করেছিলেন তিনি।
হত্যার পর আযান দেন, মক্তবে ছাত্র পড়ান
হত্যাকাণ্ডের পর অভিযুক্ত জাকির কিশোরগঞ্জ থেকে নরসিংদীর মনোহরদীতে চলে আসেন এবং নিজ বাসায় ঘুমিয়ে পড়েন। ফজরের আজানের সময় হলে মসজিদে গিয়ে আজান দেন ও নামাজে অংশগ্রহণ করেন। পাশাপাশি মক্তবে ২০ জন ছাত্রকে পড়ান।
র্যাব বলছে, গ্রেফতার মুয়াজ্জিন ধারণা করেছিল রমিজ উদ্দিনের মৃত্যুর কথা কেউ জানতে পারবে না। তাই সে তার সাধারণ রুটিন অনুযায়ী চলাচল করতে থাকে। কিন্তু ৩ অক্টোবর সকালে রমিজ উদ্দিনের মৃত্যুর বিষয়টি এলাকাবাসী জানতে পারে।
জাকির ভয়ে মসজিদ থেকে ছুটি নিয়ে আত্মগোপনে নরসিংদীর মাধবদী, ময়মনসিংহের গফরগাঁও, ময়মনসিংহ সদর, সিলেটের ফেঞ্জুগঞ্জ এবং সিলেট থেকে পুনরায় ময়মনসিংহ যান। পরে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার একটি মসজিদে আসেন এবং সেখান থেকে চল্লিশ দিনের চিল্লায় লক্ষ্মীপুরের রামগতীতে যান।
র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, শুধু ছয় লাখ টাকার জন্যই এই হত্যাকাণ্ড করা হয়েছে। এই হত্যার পরে আত্মগোপনে থাকার জন্য জাকির ৪০ দিনের চিল্লায় যান। জাকিরের সাম্প্রতিক চলাফেরা ও পরিবার অসুস্থ থাকার কথা বলে ১৫ দিন ছুটি নেওয়ায় তাকে সন্দেহেরজনক গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর সে অকপটে সব স্বীকার করে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫৫
আপনার মতামত জানানঃ