রাজধানীসহ সারাদেশে অনায়াসেই ছড়িয়ে পড়ছে বোতল বোমা। ঘরের কোণা থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে রেস্তোরাঁ, এমনকি গণপরিবহনেও এই বোতল বোমার স্থান মিলেছে হরহামেশাই। সারাদেশে বিভিন্ন গণপরিবহনেও সিলিন্ডারের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।
সিএনজি থেকে শুরু করে প্রাইভেটকারও এখন গ্যাসেই চলছে। তবে অধিকাংশ পরিবহনের গ্যাস সিলিন্ডারই ঝুঁকিপূর্ণ। আবার অধিকাংশ হিউম্যান হলারে (গাড়ি) গ্যাস সিলিন্ডারের বদলে অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বাড়ছে প্রাণহানির আশঙ্কা। যানবাহনের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবহৃত সিলিন্ডার প্রতি ৫ বছর পরপর রিটেস্ট (পুনঃপরীক্ষা) করার বিধান থাকলেও বাস্তবে তার কোনো মিল দেখা যায় না। বছরের পর বছর পুরনো সিলিন্ডারে পরিবহন চললেও নেই কোনো তদারকি।
২০১৮ সালের ডিসেম্বর নাগাদ সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা করা গাড়ির সংখ্যা ছিল ৯১ হাজার ৭৭১টি। এ সংখ্যা ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ হাজার ২৬৯টিতে। আড়াই লাখেরও বেশি গাড়ির সিএনজি সিলিন্ডার মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলেও গত দুই বছরে সিলিন্ডার পরীক্ষা করিয়েছে মাত্র সাড়ে সাত হাজার গাড়ি। এজন্য মালিকদের অসচেতনতা দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দিতে একটি চলন্ত বাসে আগুন ধরে যায়। বাসের গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। একই দিন একই মহাসড়কের গজারিয়ায় আরেকটি বাসে আগুন লাগে। এতে কারো মৃত্যু না হলেও বাস থেকে তাড়াহুড়ো করে নামার সময় আহত হন পাঁচ যাত্রী। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এখানেও আগুনের সূত্রপাত গ্যাস সিলিন্ডার থেকে। যানবাহনের সিলিন্ডার দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মেরামত না করার কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে এখন নতুন করে খুব বেশি যানবাহন যেমন সিএনজিতে রূপান্তর করা হচ্ছে না, তেমনি তুলনামূলক কমে গেছে সিএনজিচালিত যানবাহন আমদানিও। আরপিজিসিএলের হিসাবে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে দেশে দেশে সিএনজিতে রূপান্তরিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ২৩৯টি। সিএনজি ফুয়েল সিস্টেমের যানবাহন আমদানির সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার ৩৮৩টি। আর সিএনজিচালিত থ্রি-হুইলার ছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি। সব মিলিয়ে ৫ লাখ ৩ হাজার ৮৬৪টি সিএনজিচালিত গাড়ি ছিল ওই সময়। দুই বছর পর বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৪ হাজার ৭৮৩টিতে।
মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী বোমার সঙ্গে তুলনীয়। সম্প্রতি চট্টগ্রামের আনোয়ারায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একটি অ্যাম্বুলেন্স দুমড়ে-মুচড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ঘটনার ছবি দেখে মনে হয়েছিল যে, সে বিস্ফোরণটি শক্তিশালী বোমার মতো বিস্ফোরিত হয়েছিল। বেসরকারি যেসব কোম্পানি গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা করে, তারা কী মানের সিলিন্ডার সরবরাহ করে, সেগুলোর নিরাপত্তার অবস্থা কী, কতদিন ব্যবহারযোগ্য ইত্যাদি বিষয়ে নজরদারির অনেক অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাসুদ খান গণমাধ্যমকে বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ফিলিং স্টেশনগুলোর। সেজন্য সমিতির পক্ষ থেকে প্রত্যেকটি ফিলিং স্টেশনেই এ ব্যাপারে সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে প্রচারণা চালানো হয়ে থাকে। নিজেদের স্বার্থেই প্রত্যেক যানবাহন মালিকের উচিত সিএনজি সিলিন্ডার সময়মতো চেক করিয়ে নেওয়া।
তিনি বলেন, এসব বিষয় তদারকি করার কথা আরপিজিসিএল ও বিআরটিএ’র।’ অথচ সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে এ ব্যাপারে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ বাস মালিক সমিতির চেয়ারম্যান ফারুক তালুকদার সোহেল বলেন, রাজধানীতে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ বাস সিএনজিতে চলে। বাকি বাসগুলো চলে ডিজেলে। কারণ, সিএনজি ও ডিজেলের মূল্যমান প্রায় সমান। যেগুলো এখনও সিএনজিতে চলছে সেগুলোও শিগগিরই ডিজেলে ফিরবে বলে মনে করেন তিনি। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বিষয়ে তিনি বলেন, নিজেদের স্বার্থেই প্রত্যেকের উচিত সময় মতো সিলিন্ডারগুলো পুনঃপরীক্ষা করানো। অন্যথায় বিপদতো নিজেদেরই হবে।
মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি সিলিন্ডার প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ব্যক্তিগত পরিবহনগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত এমনটি হয় না। পাবলিক পরিবহনে কেউ যদি মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার করে সেক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশ অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। এছাড়া, দ্রুত পুরনোটা বদলে নতুন ও ভালো মানের সিলিন্ডার ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারে।
সংশিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাঁচ বছর পরপর যানবাহনের সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা করাতে হয়। তবে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেছেন, এ কাজটি করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তাদের নেই। বর্তমানে ঢাকা ও দেশের আরো পাঁচটি বিভাগীয় অফিসে সব মিলিয়ে ৫৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকাসহ আমাদের মাত্র ছয়জন বিস্ফোরক পরিদর্শক রয়েছেন। এত সীমিতসংখ্যক জনবল দিয়ে আসলে আমাদের পক্ষে সব কাজ করা সম্ভব হয় না।
যানবাহনের সিএনজি সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার কোনো কাজই তদারক করা সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা নতুন একটি জনবল কাঠামো প্রস্তাব করেছি। এতে ১ হাজার ১১৫ জনের একটি সাংগঠনিক কাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা অনুমোদন পেলে আমাদের কার্যক্রম আরো গতিশীল হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ