চলতি শুস্ক মৌসুমে ফরিদপুরে পদ্মা নদীতে আবারও নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। এতে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো ও বড় ট্রলার চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা এসব পণ্যবাহী জাহাজ নৌবন্দরে ভিড়তে না পারায় নৌবন্দরের শুল্ক আদায়ও কমে গেছে। অন্য দিকে এসব নৌযান থেকে পণ্য খালাস করতে অতিরিক্ত মাশুল গুনতে হচ্ছে। প্রতি বছর বিপুল পরিমান রাজস্ব আদায় হলেও বন্দর উন্নয়নে নেই কোন প্রদক্ষেপ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ পদ্মা নদীর পানি কমতে শুরু করে। তখন থেকেই এসব নৌযানগুলো নাব্যতা সংকটের কবলে পড়ে সিএন্ডবি ঘাটের বন্দরে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে এই দুরাবস্থা চরমে পৌছেছে। বর্তমানে নাব্যতা সংকট রক্ষায় একটি বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে খনন কাজ করছে। তবে খননের কয়েকদিনের মধ্যেই আবার বালু এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে।
দক্ষিণবঙ্গ সহ বৃহত্তর ফরিদপুরের ব্যবসায়ীক পণ্য আনা নেয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ নৌ বন্দরটি শত বছরের প্রাচীন। ২০১৭ সালে সরকার এটিকে তৃতীয় শ্রেণির নৌ বন্দর হিসেবে গেজেট প্রকাশ করে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ বিভিন্নস্থান হতে নৌ পথে এই বন্দরে পন্য আনা নেওয়া করা হয়। ফরিদপুরের সোনালী আঁশ খ্যাত পাট এই বন্দর হয়েই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বহিঃবিশ্বে রফতানি হয়। এছাড়া সিলেট থেকে কয়লা ও বালু, ভারতের গরু ও চাল সহ চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মিরকাদিম থেকে এই নৌ পথেই চাল আমদানি হয়। নারায়ণগঞ্জ বন্দর থেকে প্রচুর সিমেন্টবাহী জাহাজ ও কার্গো এই বন্দর হতে খালাস করা হয়। কিন্তু বর্তমানে নাব্যতা না থাকায় এবং অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় এসব পণ্যবাহী নৌযান বন্দরে আসতে পারছেনা।
সরেজমিন দেখা গেছে, নৌবন্দরে ভিড়তে না পেরে অনেক দূরে দিঘির চর, ভুঁইয়াবাড়ি ঘাট, খুশির বাজার, বাইল্যা হাটা, হাজীগঞ্জের চর, চরভদ্রাসনের এমপিডাঙ্গি ও গোপালপুরসহ বিভিন্ন স্থানে নদীর তীরে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো ও বড় ট্রলার ভেড়ানো রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাট থেকে সিমেন্ট নিয়ে আসা একটি জাহাজের মাস্টার মো. দুলাল হাওলাদার। তিনি বলেন, চরভদ্রাসনে এসে ঠেকে গেছি। আমার জাহাজে ১২ হাজার বস্তা সিমেন্ট বহন করা যায়। নদীতে পর্যাপ্ত গভীরতা নেই বলে আট হাজার আনতে হয়েছে। এতে আমাদের ভাড়া কমে গেছে। তার ওপর নৌবন্দরে ভিড়তে পারলে প্রতি বস্তায় ১৪ টাকা পেতাম। কিন্তু এখন এই ভাড়ার অর্ধেক দিয়ে আরেকটি ট্রলার ভাড়া করে মাল খালাস করতে হচ্ছে। একই রকম সমস্যার কথা জানিয়েছেন অন্য অনেক নৌযানকর্মীরা।
এমবি ছায়ানীড় নামে আরেকটি জাহাজের মাস্টার মো. ফারুক বলেন, নাব্য সংকটে জাহাজের ইঞ্জিনের পাখা ভেঙে যায়। সুখান আটকে যায়। জাহাজের অনেক ক্ষতি হয়। তিনি আরও বলেন, অন্তত পক্ষে ১০ হাত গভীর পানি থাকা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখানে কোথাওবা দুই-তিন হাত পানি রয়েছে।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট পোর্ট অফিসার মাসুদ পারভেজ বলেন, নৌবন্দরটিকে সচল করতে নৌ চ্যানেলে ড্রেজিং করা হচ্ছে। তবে এখনো পথটি বড় নৌযান চলাচলের উপযুক্ত হয়নি। আশা করছি চলতি মৌসুমেই এই সঙ্কট কেটে যাবে।
ড্রেজিংয়ের পরেও কেন নাব্য ফিরে আসছে না এর কারণ জানতে চাইলে সেখানে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ড্রেজিংয়ের কাজে নিযুক্তরা জানান, ড্রেজিংয়ের পরপরই আবার নতুন বালু এসে ড্রেজিং করা স্থান ভরে যাচ্ছে। পানিতে প্রচুর পলি রয়েছে।
বন্দরের নৌযান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. হেলালউদ্দিন বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের ব্যবসায়িক পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ নৌ বন্দর। বছরের ৫ মাসের মতো সময় এখানে পানি কম থাকে বিধায় বন্দরে পণ্য খালাসে জটিলতা সৃষ্টি হয়। তিনি আরও বলেন, গত এক মাস ধরে পদ্মার বুকে অসংখ্য ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে। সেজন্য বন্দরমুখি পণ্যবাহী বেশ কিছু জাহাজ আটকা পড়েছে। ফলে শ্রমিকরা প্রায় বেকার হয়ে পড়েছেন।
ফরিদপুর নৌ বন্দরের পণ্য খালাসে নিযুক্ত প্রতিষ্ঠান লাকি ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজার মো. আবদুস সালাম বলেন, প্রায় ৮ হাজার কুলি-শ্রমিক এ নৌবন্দরে কাজ করেন। অনেক ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীও রয়েছেন। জাহাজ ও কার্গো না আসায় তারা কাজ পাচ্ছেন না। তিনি আরও বলেন, বছরের ৫ মাসের মতো সময় এখানে পানি কম থাকে বলে বন্দরে পণ্য খালাসে সমস্যা হয়। ব্যবসায়িকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। নৌ বন্দরটি ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ইউনিয়নে অবস্থিত।
ডিক্রিরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান মিন্টু বলেন, নাব্য সংকটে বন্দরটি অচল হতে বসেছে। বন্দরটিকে ঘিরে হাজার হাজার শ্রমিক-ব্যবসায়ীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছিল। বন্দরটি অচল হলে শ্রমিকরা কাজ হারাবেন। ফলে চুরি-ছিনতাই বৃদ্ধি পাবে। তিনি আরও বলেন, স্থানীয়ভাবে দ্রুতই ড্রেজার দিয়ে বালু কাটা হলে ঘাটটি সচল থাকবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ফরিদপুর নদীবন্দরটি এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীতে নাব্য সমস্যা নিরসন না হলে ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বা নারায়ণগঞ্জ থেকে মাল আনতে পারবেন না। বিকল্প উপায়ে পণ্য আমদানি হলে তার ব্যয় বেড়ে যাবে অনেক। নদীর নাব্য সংকট দূর করতে ড্রেজিংয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একটা দীর্ঘমেয়াদি মডেল করে কাজ করতে হবে। ড্রেজিং লাগবেই। কিন্তু ড্রেজিং কীভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়, সেটা দেখতে হবে। সরকারের কাছে দ্রুত সময়ের মধ্যে এ বন্দরটির নাব্য সংকট নিরসনের দাবি জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৭১০
আপনার মতামত জানানঃ