মানব সভ্যতা এক দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে বিজ্ঞানের হাত ধরে। এক সময় যে বিষয়গুলো কল্পবিজ্ঞান ছিল, আজ তার অনেক কিছুই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তবে এমন কিছু ক্ষেত্র আছে যা এখনো বিজ্ঞান ও নৈতিকতার সীমারেখার মাঝখানে দুলছে। মানুষ ক্লোনিং হচ্ছে তেমনই একটি বিষয়। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি সম্ভব, কিন্তু সমাজ, নৈতিকতা, ধর্ম ও আইন এটিকে আজও পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেনি। চলুন, এই আলোচিত বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করি।
ক্লোনিং কী?
“ক্লোনিং” শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ klōn থেকে, যার অর্থ ডালপালা বা শাখা। জীববিজ্ঞানের পরিভাষায় ক্লোনিং বোঝায় এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো জীব বা কোষের হুবহু জিনগত অনুরূপ কপি তৈরি করা হয়। এটি হতে পারে: জিন ক্লোনিং (DNA বা জিনের নির্দিষ্ট অংশ কপি করা), কোষ ক্লোনিং (একটি কোষ থেকে সমান গঠন ও জিনবিশিষ্ট কোষ তৈরি), অথবা প্রাণী ক্লোনিং, যেখানে একটি জীবের সম্পূর্ণ শরীরের জিনগত নকল তৈরি করা হয়। এই শেষ ধরণের ক্লোনিংই মূলত মানুষ ক্লোনিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।
ইতিহাস: ক্লোনিংয়ের পথচলা
১৯৫০-এর দশকে ব্যাঙের কোষ ব্যবহার করে ক্লোনিংয়ের প্রাথমিক পরীক্ষা শুরু হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে স্কটল্যান্ডে “ডলি” নামের একটি ভেড়া ক্লোন করে বিজ্ঞানীরা এক যুগান্তকারী মাইলফলক স্পর্শ করেন। এটি ছিল প্রথম সফলভাবে ক্লোন করা স্তন্যপায়ী প্রাণী।
ডলি তৈরি হয়েছিল Somatic Cell Nuclear Transfer (SCNT) নামে একটি প্রযুক্তির মাধ্যমে। এই পদ্ধতিতে একটি দাতার শরীর থেকে একটি কোষ নেওয়া হয়, তারপর তার নিউক্লিয়াস অন্য একটি ডিম্বাণুতে প্রতিস্থাপন করা হয় যেটির নিজের নিউক্লিয়াস আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। পরে তা একটি মাতৃগর্ভে প্রতিস্থাপন করে পুরো জীবটি জন্মানো হয়।
ডলির জন্মের পর থেকেই বিজ্ঞানী ও সমাজকর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠে—যদি ভেড়া ক্লোন করা সম্ভব হয়, তবে কি মানুষকেও?
মানুষের ক্লোনিং প্রযুক্তি: বাস্তবতা কত দূর?
বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, তাত্ত্বিকভাবে মানুষের ক্লোনিং সম্ভব। কারণ SCNT পদ্ধতিটি মানুষের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। কিছু গবেষণাগারে বানর বা অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের ক্লোনিং পরীক্ষামূলকভাবে সফল হয়েছে, যা মানুষের ক্লোনিংয়ের প্রযুক্তিগত ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে।
২০১৮ সালে চীনের বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো জেনেটিকালি আইডেন্টিক্যাল দুইটি বানর ক্লোন করতে সক্ষম হন—নাম ছিল ঝং ঝং ও হুয়া হুয়া। এই সাফল্য মানব ক্লোনিংয়ের দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেলেও, এর সঙ্গে সঙ্গে বিতর্কও বেড়ে যায়।
মানব ক্লোনিংয়ের উদ্দেশ্য কী হতে পারে?
চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটানো: কোনো ব্যক্তি গুরুতর অসুস্থ হলে তার শরীরের কোষ দিয়ে হুবহু একই জিনবিশিষ্ট অঙ্গ তৈরি করে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে।
বাঁজা দম্পতির জন্য বিকল্প উপায়: যাদের সন্তান ধারণ সম্ভব নয়, তারা ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে সন্তান পেতে পারেন।জটিল রোগ গবেষণায় সহায়তা: জিনগত রোগের ধরন ও চিকিৎসা নিয়ে গভীর গবেষণা করা যায়।
বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা সংরক্ষণ: কোনো বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন বা প্রতিভাবান ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক গঠন ভবিষ্যৎ প্রজন্মে সংরক্ষণের প্রয়াস।
কিন্তু মানব ক্লোনিং কি নিরাপদ?
এই প্রশ্নটাই মানব ক্লোনিংয়ের সবচেয়ে বড় বাধা। ডলিসহ অন্যান্য প্রাণীর ক্লোনিং পরীক্ষায় দেখা গেছে: ক্লোনের আয়ু সাধারণত কম, বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হয় বা অসম্পূর্ণ থাকে, ক্লোন প্রাণীর বার্ধক্য দ্রুত হয়।
মানব দেহ আরও জটিল, তাই এসব সমস্যা মানুষের মধ্যে আরও বেশি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। ফলে বিজ্ঞানীরা এখনো মানুষের উপর সরাসরি ক্লোনিং পরীক্ষা চালাতে প্রস্তুত নন।
নৈতিকতা ও ধর্মীয় বিতর্ক
এখানে এসে মানব ক্লোনিং নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ওঠে: এটা কি নৈতিক? অনেক ধর্মবিশ্বাস বলে, মানুষ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। তাকে কৃত্রিমভাবে নকল করা ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আবার অনেকে বলেন, একটি ব্যক্তির পূর্ণ কপি তৈরি করলে তার ব্যক্তিসত্তা কোথায় থাকবে? তার কি নিজস্ব পরিচয় থাকবে না?
তবে এই প্রশ্নগুলোও বিতর্ককে জোরদার করে: ক্লোন শিশুর অধিকার কী হবে? তার পরিচয়—সে কার সন্তান? সে কি একটি গবেষণার বস্তু না একজন পূর্ণ মানুষ?
এছাড়াও, ক্লোনিং ব্যবহৃত হলে কোনো শাসক বা ধনী ব্যক্তি নিজের একাধিক কপি তৈরি করে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইতে পারেন—এটা ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ হতে পারে।
বৈশ্বিক আইন ও নিষেধাজ্ঞা
বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই মানব ক্লোনিং আইনত নিষিদ্ধ। জাতিসংঘ ২০০৫ সালে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে যাতে মানব ক্লোনিংয়ের বিরুদ্ধে মত দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স—প্রায় সব দেশেই মানব ক্লোনিং নিষিদ্ধ বা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।
তবে কিছু দেশ গবেষণার জন্য থেরাপিউটিক ক্লোনিং (যেখানে কেবল কোষ ক্লোন করে অঙ্গ বা টিস্যু তৈরি করা হয়, মানুষ নয়) সীমিত পরিসরে অনুমোদন দিয়েছে।
মানব ক্লোনিং এখনো বাস্তব হয়নি, তবে তা আর খুব দূরে নয় বলেই মনে করেন অনেক বিজ্ঞানী। জিন প্রযুক্তি, স্টেম সেল রিসার্চ ও কোষীয় জৈবপ্রযুক্তিতে যে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ক্লোনিং অনেক সহজ ও নিরাপদ হয়ে উঠতে পারে।তবে প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কি সেই ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত?
মানব ক্লোনিং এমন একটি বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা যার সম্ভাবনা অনেক, কিন্তু এর সঙ্গে রয়েছে বিপুল নৈতিক, সামাজিক ও আইনগত জটিলতা। এটি যেমন চিকিৎসা ও গবেষণায় এক বিপ্লব ঘটাতে পারে, তেমনি ভুলভাবে ব্যবহৃত হলে তা মানব সভ্যতার জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
তাই মানব ক্লোনিং নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে গভীরভাবে, শুধুমাত্র বিজ্ঞান দিয়ে নয়—নৈতিকতা, মানবতা ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও। বিজ্ঞান সবসময়ই এগিয়ে যাবে, কিন্তু সেই অগ্রগতিকে সঠিক পথে ব্যবহার করাটাই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
প্রয়োজন হলে ফিচারটির কিছু অংশ ছোট করে সংক্ষিপ্তও করা যেতে পারে, কিংবা নির্দিষ্ট কোনো দিক—যেমন “নৈতিকতা” বা “চিকিৎসায় প্রয়োগ”—আলাদা করে বিস্তারেও লেখা যেতে পারে। চাইলে আমি সেগুলোর জন্যও সাহায্য করতে পারি।
আপনার মতামত জানানঃ