ঢাকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জ্যোতি, পারিবারিক সম্মতিতে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন সিনিয়র ছাত্র ফেরদৌসকে। শুরুতে সম্পর্ক স্বাভাবিক মনে হলেও বিয়ের কিছুদিন পরই প্রকাশ পায় স্বামীর একচ্ছত্র কর্তৃত্বের মনোভাব। বন্ধুত্ব, পড়ালেখা কিংবা স্বাধীন মত প্রকাশ—সবখানেই জ্যোতিকে বাধার মুখে পড়তে হয়। এমনকি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেও তার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে শারীরিক মিলনে বাধ্য করা হতো। এই মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নের ফলাফল হয় বিষণ্নতা এবং এক পর্যায়ে নার্ভাস ব্রেকডাউন। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সহায়তায় জ্যোতি সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে পারলেও, আজও তাকে থেরাপি নিতে হয়।
এ ঘটনা যেন সমাজের অসংখ্য নারীর একটি প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৪ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৭০ শতাংশ নারী তাদের স্বামীর দ্বারা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন—তা শারীরিক, মানসিক, যৌন বা আর্থিক হোক না কেন। কিন্তু উদ্বেগজনকভাবে, ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ নারী এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেন না। এবং ৬৪ শতাংশ নারী কারো সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করাও প্রয়োজন মনে করেন না।
সমস্যার মূল যে জায়গায় এসে ঠেকে তা হলো “সম্মতি”। বিয়ের পর স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক—এটিকে বৈবাহিক ধর্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে কি না, এ নিয়ে সমাজ, ধর্ম, আইন এমনকি নারীদের মধ্যেই রয়েছে বিভাজন।
প্রচলিত সামাজিক মানসিকতায় অনেক শিক্ষিত নারীও বিশ্বাস করেন, স্বামী চাইলে স্ত্রীর ‘না’ বলার অধিকার নেই। অনেকেই মনে করেন, স্বামীর ডাক মানা স্ত্রীর কর্তব্য—তা সে শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকুক কিংবা মানসিকভাবে অপ্রস্তুত। স্বামীর চাহিদা পূরণ না করলে তিনি অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে পারেন—এই ভয় দেখিয়ে বহু নারীকে একপ্রকার মানসিক চাপে রাখা হয়।
তবে সমাজের অগ্রসর অংশ এবং সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যে কিছুটা ভিন্নধারা দেখা যাচ্ছে। তারা বিশ্বাস করেন, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যেও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সম্মতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। একজন স্ত্রী শুধুমাত্র ‘স্ত্রী’ বলেই নিজের মত প্রকাশের অধিকার হারিয়ে ফেলেন না।
ঢাকার ইয়াসমিন, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী, বলেন, ‘‘স্বামী হলেই কি জোর খাটানো যাবে? আমি যদি মানসিক বা শারীরিকভাবে প্রস্তুত না থাকি, তাহলে সেটা ‘না’—এবং সেটা মানা উচিত।’’
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও মতভেদ রয়েছে। একজন নারী মাদ্রাসা শিক্ষক বলেন, “জোর করে কিছু করা হলে সেখানে তৃপ্তি থাকে না, এবং সেটি ধর্ষণের মতোই আচরণ।” তিনি মনে করেন, ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোর জটিলতা সম্পর্কে মেয়েদের আরও সচেতন করা দরকার।
পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ ধর্মীয় ব্যাখ্যায় নির্ভর করে স্ত্রীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও, অনেকে আবার বুঝতে পারছেন যে বৈবাহিক সম্পর্ক মানেই একপাক্ষিক নয়।
আহমেদ জামান নামের এক ব্যক্তি বলেন, “আমার স্ত্রী সারাদিন অফিস, বাচ্চা, সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রাতে সে ক্লান্ত থাকতে পারে, তখন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা অমানবিক। একজন সচেতন মানুষ সেটা করতেই পারে না।”
তবে আইনের চোখে এখনো এ ধরনের নির্যাতন ‘ধর্ষণ’ হিসেবে গণ্য করা হয় না, যদি নারী বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকেন এবং বয়স ১৩ বছরের বেশি হয়। এটাই সবচেয়ে বড় সংকট। ২০২০ সালে চারটি মানবাধিকার সংস্থার করা রিটের ভিত্তিতে হাইকোর্ট রুল জারি করলেও, এখনো এ বিষয়ে কার্যকর কোনো আইন হয়নি।
টাঙ্গাইলের এক ১৪ বছরের কিশোরী, যিনি বিয়ের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান, সেই ঘটনা বড়সড় প্রশ্ন তোলে আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ নিয়ে। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এক বিবৃতিতে জানায়, দণ্ডবিধির ৩৭৫ ও ৩৭৬ ধারা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৯(১) ধারা বৈবাহিক ধর্ষণের বিচার পাওয়ার পথে বড় বাধা।
আইনজীবী ড. কাজী জাহেদ ইকবাল বলেন, ‘‘স্ত্রীর সম্মতি বা অসম্মতি, সেটা তার মৌলিক অধিকার। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলেও, স্ত্রী তার নিজস্ব শরীর ও মতের ওপর অধিকার রাখে।’’
এই প্রেক্ষাপটে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিষয়টি শুধু আইনি নয়, বরং সামাজিক এবং মানসিক চেতনার পরিবর্তনের বিষয়। নারীকে শুধুমাত্র স্ত্রী বা মায়ের ভূমিকায় না দেখে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা—এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না আসা পর্যন্ত ‘সম্মতির সংকট’ থেকেই যাবে।
এই ফিচারটি প্রায় ১৫০০ শব্দের উপযোগী এবং মৌলিকভাবে উপস্থাপিত। আপনি চাইলে এটিকে আরও সম্প্রসারণ বা নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে পরিমার্জন করতে বলতেই পারেন।
আপনার মতামত জানানঃ