ভারতের কলকাতা শহরে একটি প্রথম সারির মেডিকেল কলেজে কতর্ব্যরত অবস্থায় একজন তরুণী চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশের ডাক্তারসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিবাদ তুঙ্গে উঠেছে।
৩১ বছর বয়সী ওই তরুণীর দেহের ময়না তদন্তে চরম যৌন লাঞ্ছনার প্রমাণ মিলেছে এবং কর্তৃপক্ষ গোটা ঘটনাটি প্রথমে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল – এই ধরনের অভিযোগ ওঠার পর সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কার্যত ফুঁসে উঠেছেন।
নিহত তরুণী ছিলেন কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ হসপিটালের একজন চিকিৎসক। কলকাতার কাছে শহরতলি সোদপুর এলাকার একটি অতি সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার রাতে তিনি টানা ৩৬ ঘণ্টার ‘অন-কল’ ডিউটিতে ছিলেন, রাতে প্যারিস অলিম্পিকে জ্যাভেলিন থ্রো-র ইভেন্ট টিভিতে দেখে এবং অনলাইনে আনানো খাবার সহকর্মীদের সঙ্গে খেয়ে তিনি চারতলায় পালমোনোলজি বিভাগের সেমিনার হলে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে যান।
পরদিন সকালে তার জুনিয়র সহকর্মীরা ওই হলের ভেতরেই তার অর্ধনগ্ন মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। নিহত তরুণীর গোপনাঙ্গের পাশেই পড়ে ছিল মেয়েদের মাথার চুলের একটি ক্লিপ।
ওই তরুণীর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ তাদের প্রথমে জানিয়েছিল তাদের মেয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেছে। পরে অবশ্য তীব্র জনরোষ ও ক্ষোভের মুখে পুলিশ এই ঘটনায় খুন ও ধর্ষণের মামলা দায়ের করেছে।
এমনকি আর জি কর মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে, তিনিও বিষয়টি আত্মহত্যা বলে ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, “রাতের বেলায় একা একা সেমিনার হলে গিয়ে মেয়েটি দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করেছে।”
পরে আন্দোলনরত মেডিকেল ছাত্রছাত্রী ও ডাক্তারদের চাপের মুখে অভিযুক্ত ওই প্রিন্সিপাল সোমবার সকালে নিজের পদ ও সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। কিন্তু এই ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে কলকাতাসহ দেশজুড়ে প্রতিবাদ অব্যাহত আছে।
হাসপাতালের সেমিনার হল থেকে ওই তরুণীর দেহ উদ্ধারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ মূল অভিযুক্ত সন্দেহে সঞ্জয় রায় নামে এক ব্যক্তিকে আটক করেছে, যিনি কলকাতা শহরের পুলিশ বাহিনীতে ‘সিভিক ভলান্টিয়ার’ বা সহযোগী কর্মী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
‘সিভিক ভলান্টিয়ার’ হল এমন একটি পদ যা পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে রাজ্য সরকার চালু করেছে। এই পদধারীরা সরাসরি পুলিশ বা ট্র্যাফিক পুলিশের সদস্য না হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে তাদের সাহায্য করে থাকেন, রাজ্য সরকারের কাছ থেকে মাসোহারাও পান।
পুলিশ জানিয়েছে, আর জি কর মেডিকেল কলেজে সে দিন রাতের সিসিটিভি ফুটেজ দেখেই অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই তরুণীর সঙ্গে যখন পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তার ঠিক আগে ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে ঢুকতে দেখা যায় এবং তার খানিকক্ষণ পরে বেরিয়ে যেতে দেখা যায় বলেও জানানো হয়েছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ধৃত ওই ব্যক্তির বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হওয়ার এবং নির্যাতন ও চাঁদাবাজিতে যুক্ত থাকার অতীত ইতিহাস আছে। তবে আন্দোলনরত চিকিৎসকরা ও পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলো বারবার দাবি জানানো সত্ত্বেও হাসপাতালের কোনও সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশ প্রকাশ করেনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, পালমোনোলজি বিভাগের ও সেমিনার হলের সিসিটিভি সে দিন কাজ করছিল না।
মূল অভিযুক্ত ও ধৃত সঞ্জয় রায় ২০১৯ সালে কলকাতা পুলিশের ডিসঅ্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপে একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন।
পরে রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি বদলি নেন কলকাতা পুলিশের ‘ওয়েলফেয়ার সেল’ বা কল্যাণ সমিতিতে – যার সুবাদে আর জি কর হাসপাতাল কমপ্লেক্সে তারা অবাধ যাতায়াত ছিল বলেও বলা হচ্ছে।
এমনকি, পুলিশ বাহিনীর সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও ওই ব্যক্তি থাকতেন কলকাতা পুলিশের ফোর্থ ব্যাটেলিয়নের চত্বরেই। চলাফেরা করতেন কলকাতা পুলিশের স্টিকার লাগানো একটি মোটরবাইকে।
কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত কুমার গোয়েলকে শনিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে বারবার প্রশ্ন করা হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তি ‘সিভিক ভলান্টিয়ার’ হিসেবে পুলিশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না অথবা নিয়োগের আগে তার ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ করা হয়েছিল কি না, সে ব্যাপারে কিছুই বলতে চাননি।
নিহত ওই তরুণী চিকিৎসকের খুনী ও ধর্ষণকারীদের চরমতম শাস্তির দাবিতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন হাসপাতালে তার সহকর্মী জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলনে নেমেছেন গত শুক্রবার থেকেই।
ইমার্জেন্সি পরিষেবা বাদ দিয়ে হাসপাতালের বাকি সব বিভাগেই ডাক্তাররা রোগী দেখা বন্ধ রেখেছেন। সর্বভারতীয় স্তরে চিকিৎসকদের সংগঠন আইএমএ-ও এই আন্দোলনে তাদের সংহতি জানিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা এর ফলে কার্যত স্তব্ধ হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের ডাক্তাররা এই ঘটনায় ‘ফাস্ট ট্র্যাক বিচারবিভাগীয় তদন্ত’ চেয়েছেন, নিহতের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং কলকাতা পুলিশকে তাদের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে বলেও দাবি জানাচ্ছেন।
আন্দোলনরত ডাক্তারদের তরফে একজন বিবিসি বাংলাকে সোমবার বিকেলে বলেন, “আমরা ঘটনার যে বিবরণ পেয়েছি তাতে এটা পরিষ্কার যে খুন ও ধর্ষণে একাধিক ব্যক্তি জড়িত ছিল। মাত্র একজনকে ধরা হলেও বাকিরা রাজনৈতিক প্রভাবশালী বলেই কি তাদের স্পর্শ করা হচ্ছে না?”
তারা আরও জানাচ্ছেন নিহত ওই তরুণীর পোস্টমর্টেম ও অটোপ্সি রিপোর্টের কপি তাদের হাতে এসেছে, যা থেকে দেখা যাচ্ছে তার স্টার্নাম, কলারবোনও পেলভিক জয়েন্ট ভেঙে গিয়েছিল। চোখ, মুখ ও যৌনাঙ্গ থেকে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছিল।
তার বাঁ পায়ে, ডান হাতে, ডান হাতের আঙুলে, ঘাড়ে ও ঠোঁটে মোট ১১টি ক্ষত ছিল। সারা শরীরে নির্যাতনের যে ধরনের লক্ষণ পাওয়া গেছে তা থেকেই তার সহকর্মীরা মনে করছেন এই কাজ কিছুতেই একজন ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব নয়।
এই ঘটনায় ‘প্রকৃত দোষী’দের আড়াল করা হচ্ছে কি না, ধৃত সঞ্জয় রায় ছাড়া অন্য আরও কেউ এই অপরাধে যুক্ত কি না, সামাজিক মাধ্যমে ও চলমান আন্দোলনে এই সব প্রশ্ন তাই ঘুরেফিরেই আসছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী, যার সরকার এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ চাপের মুখে আছে, আজ নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে জানান, তিনি এই ঘটনার কিনারা করার জন্য কলকাতা পুলিশকে আগামী রবিবার (১৮ অগাস্ট) পর্যন্ত সময় দিচ্ছেন।
তার মধ্যে তদন্ত সফল না হলে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-এর হাতে তদন্তের ভার তুলে দিতেও দ্বিধা করবেন না বলে জানান মিস ব্যানার্জী।
আপনার মতামত জানানঃ