চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তের ওপারে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে মো. আব্দুল্লাহ (৩৫) নামে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়েছেন। রোববার রাতে শিবগঞ্জ উপজেলার ওয়াহেদপুর সীমান্তের ওপারে ভারতীয় অংশে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। নারায়ণপুর ইউপি সদস্য আব্দুল আলীম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আব্দুল্লাহ সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ নিশিপাড়ার মৃত নজরুল ইসলামের ছেলে।
ইউপি সদস্য আব্দুল আলীম জানান, রোববার রাতে আব্দুল্লাহসহ কয়েকজন বাংলাদেশি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। এ সময় বিএসএফ গুলি করলে ঘটনাস্থলেই মারা যান আব্দুল্লাহ। তবে অক্ষত অবস্থায় তার সহযোগীরা বাংলাদেশি ফিরে আসেন।
স্থানীয়রা জানায়, বিএসএফ সদস্যরা আব্দুল্লাহর মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। আব্দুল্লাহ গরু চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি গরু আনতেই ভারতে যান বলে জানা যায়।
৫৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মনির উজ জামান বলেন, ‘সীমান্ত এলাকা থেকে একজন বাংলাদেশি মারা গেছেন এমন তথ্য জেনেছি। এ বিষয়ে বিএসএফকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে বিএসএফ এখনো চিঠির উত্তর দেয়নি।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত শুধু বিএসএফের সরাসরি গুলিতে নিহত হয়েছে ২২ বাংলাদেশি। আহত হয়েছে ২০ জনের বেশি। গুলি ছাড়াও এ সময়ে সীমান্তে ঘটেছে আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।
বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায়ও দেখা যায়, সীমান্তে হত্যা কখনোই থামেনি। বরং কোনো কোনো বছর এই সংখ্যা ছাড়িয়েছিল চল্লিশের ঘর। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২২ সালে বিএসএফের গুলি, নির্যাতন ও ধাওয়ায় ২৩ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। ২০২১ সালে বিএসএফের হাতে গুলিসহ বিভিন্নভাবে হত্যার শিকার হয়েছিল ২০ জন। ২০২০ সালে গুলি ও নির্যাতনে হত্যার ঘটনা ঘটে ৪৮টি। ২০১৯ সালে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে ৪৬ জন নিহত হয়। ২০১৮ সালে বিএসএফর গুলিতে নিহত হয় ৮ জন এবং নির্যাতনে নিহতের সংখ্যা ছিল ৬ জন। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৪ জন।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে, বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করে। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে এক প্রতিবেদনে সীমান্তে গুলি থেকে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ ছিল, বিএসএফ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করে বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী আত্মরক্ষার প্রয়োজনে প্রথমে সতর্ক করতে ফাঁকা গুলি ছুড়তে হবে। যদি এতে হামলাকারী নিবৃত না হয় এবং জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে গুলি ছোড়া যাবে, তবে সেটা হতে হবে অবশ্যই হাঁটুর নিচের অংশে। কিন্তু এসবের কোনো তোয়াক্কাই যেন নেই বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। ফেলানী হত্যার দৃশ্যই কি মনে করিয়ে দেয় না, বিএসএফ গুলি ছোড়ে স্রেফ হত্যার উদ্দেশ্যেই। বিএসএফ কোনো ক্ষেত্রেই প্রমাণ করতে পারেনি যে, হতাহতের শিকার মানুষগুলোর মাধ্যমে তাদের প্রাণ সংশয় বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি ছিল।
সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার অন্যতম প্রধান কারণ দেশটির সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ। এ ছাড়াও দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। এখানকার একশ্রেণির মানুষ কৃষি ও অন্যান্য পেশার পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত গবাদি পশু ও পণ্য পাচারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। এই হত্যার শিকার অধিকাংশই বিভিন্ন চোরাচালান কর্মের সঙ্গে জড়িত বলেই অভিযোগ বিএসএফের। কিন্তু দুই দেশের আইন অনুযায়ী, কেউ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করলে, কাঁটাতার কাটলে বা পাচারের চেষ্টা করলে তাদের গ্রেপ্তার করে ওই দেশের আইনানুযায়ী বিচার করতে হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই গুলি ছোড়া বা নির্যাতন করা যাবে না।
ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তে মারণাস্ত্র বা লেথাল ওয়েপন ব্যবহার না করার কথা বলে আসছে। কিন্তু সীমান্তে বিএসএফের হাতে হত্যার শিকার ৯০ ভাগই গুলিতে নিহত হয়ে থাকেন। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও দেশটি দিয়েছে বারবার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখছে না ভারত।
আপনার মতামত জানানঃ