ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপে খোঁজ পাওয়া গিয়েছে ‘ফিগারেটিভ আর্ট’ বা আলংকারিক গুহা চিত্রের প্রাচীনতম নিদর্শনের। অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার বিজ্ঞানীদের উদঘাটন করা প্রাচীনতম এই চিত্রকলা শুধু মানব সভ্যতায় শিল্পের বিকাশের দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, মানুষের চিন্তার বিকাশ এবং তার বিবর্তনের বিষয়েও নতুন এক দিশার সন্ধান দিয়েছে।
একটি বন্য শূকর এবং তিনটে মানবাকৃতি যুক্ত এই চিত্রকর্ম কমপক্ষে ৫১ হাজার ২০০ বছরের পুরানো। এর আগে যে প্রাচীনতম গুহা শিল্প আবিষ্কার করা হয়েছিল তার চেয়ে ৫ হাজার বছরেরও বেশি পুরানো ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি গুহায় পাওয়া চিত্রকর্মটি।
এই আবিষ্কার সেই সময়কালকে নির্দেশ করে যখন আধুনিক মানুষ প্রথমবার তাদের সৃজনশীল চিন্তার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিল। অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ম্যাক্সিম ওউবের বিবিসি নিউজকে জানিয়েছেন মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে ধারণা পাল্টে দিতে পারে এই নবতম আবিষ্কার।
“একটা জটিল গল্প বলে এই চিত্র। গল্প বলার বিষয়ে এটাই কিন্তু আমাদের কাছে এখনও পর্যন্ত প্রাচীনতম প্রমাণ। সেই সময় মানুষের যে বিমূর্ত পদে চিন্তা করার ক্ষমতা ছিল, তা-ও দর্শায় এই চিত্রকলা,” বলেছেন তিনি।
এই গুহাচিত্রে দেখা যায় একটা শূকর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ আংশিক খোলা। সঙ্গে ওই ছবিতে দেখা মেলে তিনটে মানবাকৃতিরও। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে মানব আকৃতি রয়েছে, তার দুই বাহুই প্রসারিত। দেখে মনে হয় রডের মতো কিছু একটা ধরে আছে মানুষটি।
গুহাচিত্রে দ্বিতীয় যে মানব আকৃতি লক্ষ্য করা যায় তার মাথা শুকরের মুখের ঠিক পাশেই আঁকা। তার হাতেও লাঠির মতো কিছু একটা রয়েছে বলে মনে হয়। লাঠির একটা প্রান্ত শূকরের গলার সংস্পর্শে রয়েছে বলে অনুমান করা যেতে পারে।
গুহাচিত্রে শেষ যে মানুষের আকৃতির ছবি দেখা যায়, আপাতদৃষ্টিতে তার মাথা নিচের দিকে আর পা উপরের দিকে তোলা। ছবি থেকে অনুমান করা যায় তার পা বাইরের দিকে সম্প্রসারিত আর একটা হাত শূকরের মাথা স্পর্শ করছে।
বিজ্ঞানীদের যে দল এই আবিষ্কারটি করেছে তার নেতৃত্বে ছিলেন জাকার্তার ন্যাশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন এজেন্সি-র রক আর্ট বিশেষজ্ঞ আদি আগুস ওকতাভিয়ানা। তিনি জানিয়েছেন এই আখ্যানে যে গল্প বলা হয়েছে সেটা ইন্দোনেশিয়ার আদি মানব সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
“মানুষ সম্ভবত ৫১ হাজার ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গল্প বলে আসছে। কিন্তু যেহেতু শব্দের জীবাশ্ম হয় না, তাই একমাত্র চিত্রকলার মাধ্যমেই কোনও দৃশ্য বর্ণনার সূত্র ধরে পরোক্ষভাবে আমরা এর (গল্প বলার) খোঁজ পাই। এবং সেদিক থেকে সুলাওয়েসির এই শিল্পকলাই এখন প্রত্নতত্ত্বের কাছে এর (গল্প বলার) প্রাচীনতম প্রমাণ,” বলেছেন এই ইন্দোনেশিয়ান বিশেষজ্ঞ।
আঁকার প্রথম প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লম্বোস গুহায়। পাথরের উপর পাওয়া এই অঙ্কন ৭৫ হাজার বছর থেকে একলক্ষ বছরের পুরানো। এগুলো ‘জিওমেট্রিক প্যাটার্ন বা জ্যামিতিক চিত্র; প্রতিনিধিত্বমূলক শিল্প নয়, যেমনটা দেখা গিয়েছে সুলাওয়েসি গুহায়।
দক্ষিণ সুলাওয়েসির মারোস-পাংকেপ অঞ্চলের লেয়াং কারামপুয়াং-এর চুনাপাথরের গুহায় যে চিত্রকলা আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা সেটি আলংকারিক শিল্পের প্রতিফলন। যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা এই চিত্রকলা সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি বা তারা তাদের আশপাশের জগতের একটি বিমূর্ত উপস্থাপনা করতে চেয়েছিলেন।
মানব প্রজাতির চিন্তা প্রক্রিয়ার বিবর্তন যা শিল্প ও বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছে, তার প্রতিনিধিত্ব করে এই চিত্রকলা। এর সূত্র ধরে ধারণা করা যায় মানব চিন্তার বিকাশ কীভাবে ঘটে থাকতে পারে। এই প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই উঠে থাকে সেটি হলো কী থেকে মানব মনের এই জাগরণের সূচনা হয়েছিল।
এই বিষয়টি বিশদভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল নেচার জার্নালের প্রতিবেদনে। ড. হেনরি জি নেচার জার্নালের একজন সিনিয়র সম্পাদক। “প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে এমন কিছু একটা ঘটেছিল বলে মনে হয় যার ঠিক পরেই নিয়ান্ডারথাল এবং তথাকথিত হবিটের মতো মানুষের অন্যান্য সমস্ত প্রজাতির মৃত্যু হয়েছিল,” বলেছেন ড. হেনরি জি।
কী থেকে মানব চিন্তার বিকাশ হয়ে থাকতে পারে যার প্রতিফলন গুহার চিত্রেও পাওয়া গিয়েছে, সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কোনও একটা সময় মানুষের মস্তিষ্কে কিছু ঘটেছিল (যার ফলে চিন্তার বিকাশ) এমন ভাবনাটা বেশ রোমান্টিক। কিন্তু আমি মনে করি যে প্রতিনিধিত্বমূলক শিল্পের অনেক উদাহরণ রয়েছে এর আগেও রয়েছে।”
লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের অধ্যাপক ক্রিস স্ট্রিংগার বিশ্বাস করেন যে প্রাচীন প্রতিনিধিত্বমূলক শিল্পের উদাহরণ থাকতে পারে আফ্রিকায়, যেখানে আধুনিক মানুষ প্রথম বিকশিত হয়েছিল। সেই শিল্পের প্রমাণ অবশ্য এখনও পাওয়া যায়নি।
ইন্দোনেশিয়ার চুনাপাথরের গুহায় পাওয়া এই আলংকারিক চিত্রের আবিষ্কার সেই ধারণাকেই আরও দৃঢ় করে বলে মনে করেন অধ্যাপক স্ট্রিংগার।
সর্বশেষ সেই আবিষ্কারের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “এটি (সাম্প্রতিক আবিষ্কার) এই ধারণাটাকে শক্তিশালী করে যে প্রতিনিধিত্বমূলক শিল্পের বিকাশ প্রথমে হয়েছিল আফ্রিকায়। এবং সেটি প্রায় ৫০,০০০ বছরেরও আগে। একই সঙ্গে সেই ধারণাকেও মজবুত করে যে মানব প্রজাতির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তা অন্য জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়ে।”
“যদি তা সত্যি হয়, তা হলে আফ্রিকা এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে এর সমর্থনে পর্যাপ্ত প্রমাণ পেতে হবে যা এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। স্পষ্টতই, এই প্রাচীনতম ‘ডেটিং’ (সুলাওয়েসি দ্বীপে পাওয়া গুহা চিত্রের বয়সের প্রসঙ্গে) একটা নির্দিষ্ট সাইটে একটা প্যানেলে কাজ করে পাওয়া গিয়েছে।”
“আশা করা যায় অন্যান্য সাইট থেকে আরও বেশি ‘ডেটিং’ করা হবে যাতে এই গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানের (সুলাওয়েসি দ্বীপে পাওয়া গুহা চিত্রের) সঠিক বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।”
কোনও বস্তু বা ঘটনার বয়সকাল নির্ধারণের জন্য ‘ডেটিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সময়কাল নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘ডেটিং’-এর এক নয়া পদ্ধতি গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন দিশা দিয়েছে।
এই পদ্ধতিতে লেজার ব্যবহার করে শিল্পের নিদর্শনকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে কাটা হয়। যার ফলে গবেষকরা শিল্পকলার বিভিন্ন সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম অংশকে আরও বিস্তারিতভাবে অধ্যয়ন করতে সক্ষম হন এবং তার সঠিক ডেটিং নির্ধারণ করতে পারেন।
ডেটিং এর এই নতুন পদ্ধতি আরও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে, সারা বিশ্বে যে কয়টি গুহাযুক্ত সাইট রয়েছে তার বয়সকাল পুনরায় নির্ধারণ করা যেতে পারে।
এর হাত ধরে প্রতিনিধিত্বমূলক শিল্পের উত্থানের সময়কাল আরও খানিকটা পিছিয়ে যেতে পারে বলে অনুমান করা হয়। এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত নিদর্শন আবিষ্কার হয়েছে এবং তাদের যা বয়স জানা গিয়েছে, দেখা যাবে তার আগেও প্রতিনিধিত্ব মূলক শিল্পের অনেক উদাহরণ রয়েছে।
মাত্র দশ বছর আগেও প্রাচীন গুহা শিল্পের একমাত্র প্রমাণ মিলেছিল স্পেন এবং দক্ষিণ ফ্রান্সের মতো জায়গায়। এই আবিষ্কারের পর অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন সৃজনশীল চিন্তার জাগরণ যা শিল্প এবং বিজ্ঞানের দিকে মানুষকে পরিচালিত করেছিল তার শুরু হয়েছিল ইউরোপে।
কিন্তু সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছিল ২০১৪ সালে দক্ষিণ সুলাওয়েসির এক গুহার আবিষ্কার। সেখানে সুম্পাং বিটা গুহায় মানুষের হাতের রঙিন ছাপ পাওয়া গিয়েছিল। আনুমানিক ৩৯ হাজার বছর আগের এই চিত্র।
এরপর ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও দ্বীপের লুবাং জেরিজি সালেহ গুহায় ৪০ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো এক অজানা প্রাণীর প্রতিনিধিত্বমূলক শিল্পকর্ম খুঁজে পান বিজ্ঞানীরা। মনে করা হতো এটাই প্রাচীনতম প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্রকর্ম। সেই ধারণাও ভেঙেছে।
গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাডাম ব্রুম মনে করেন, ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপের গুহায় ৫১ হাজার দুশো বছরের পুরানো যে সর্বশেষ আলঙ্কারিক চিত্র আবিষ্কার হয়েছে সেটা শিল্পের ইতিহাসে গল্প বলার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তার ওপর নতুনভাবে আলোকপাত করেছে।
অধ্যাপক ব্রুম বলেছেন, “এটা লক্ষ্য করার বিষয় যে সুলাওয়েসিতে আমরা যে এখনও পর্যন্ত প্রাচীনতম যে গুহা শিল্প পেয়েছি তা দৃশ্যের সমন্বয়ে গঠিত। অর্থাৎ, এই চিত্রকর্মে মানুষ এবং প্রাণীর মিথস্ক্রিয়া এমনভাবে আঁকার চেষ্টা ছিল যা এক ধরনের আখ্যান। এক কথায় বলতে গেলে গল্প বলতে চাওয়া হয়েছিল।”
আপনার মতামত জানানঃ