তৎকালীন বাংলায় জমিদার হিসেবে বেশ কয়েকজন নারী দায়িত্বপালন করেছেন, কিন্তু নবাব উপাধি পাওয়া একমাত্র জমিদার ছিলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। তিনি কেবল প্রথম নারী নবাব হিসেবেই নন, নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জনহিতকর কাজের জন্য ইতিহাসে পরিচিত হয়ে আছেন। এর বাইরে তিনি সাহিত্যচর্চাও করতেন।
মুসলমান নারীদের লেখা প্রথম বাংলা সাহিত্যকর্ম ‘রূপজালাল’ এর লেখক ছিলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরী। ১৮৩৪ সালে কুমিল্লার হোমনাবাদ পরগনা যা এখন লাকসাম উপজেলার পশ্চিমগাঁওয়ে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন।
তিনি আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত এবং বাংলাসহ কয়েকটি ভাষা লিখতে, পড়তে এবং বলতে পারতেন।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী কবে থেকে জমিদারির দায়িত্ব নেন তা নিয়ে কিছুটা ভিন্নমত পাওয়া যায়। তার নবাব উপাধি পাওয়ার পেছনে একটি গল্প রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আরিফা সুলতানা বিবিসিকে বলেছেন, ১৮৮৯ সালে রানি ভিক্টোরিয়া তাকে নবাব উপাধি প্রদান করেন, কিন্তু তার আগে দুইবার ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী তাকে দেওয়া ব্রিটিশ সরকারের ‘বেগম’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ‘ফয়জুন্নেসার জনহিতৈষণার পুরস্কারস্বরূপ মহারানী ভিক্টোরিয়া ১৮৮৯ সালে তাকে ‘নবাব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনিই বাংলার প্রথম মহিলা যিনি এই উপাধি লাভ করেন’।
রওশন আরা বেগমের লেখা ‘নবাব ফয়জুন্নেসা ও পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ’ নামে বইয়ে বলা হয়েছে, ঐ সময় ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ডগলাস।
স্থানীয় উন্নয়ন কাজে সরকারি অর্থ আসতে দেরি হওয়ায় তিনি স্থানীয় ১০জন জমিদারের কাছে ঋণ হিসাবে ১০ হাজার টাকা করে এক লাখ টাকা চেয়েছিলেন।
কিন্তু স্বল্প সুদে কেউই যখন তাকে ঋণ দেয়নি, সেসময় ফয়জুন্নেসা চৌধুরী এক লাখ টাকা দান করেন ডগলাসকে। এবং তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, ঐ অর্থ ফেরত দিতে হবে না।
বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘নবাব ফয়জুন্নেসা ও পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ’ বইটিতে বলা হয়েছে, ফয়জুন্নেসার এই অবদানের কথা ম্যাজিস্ট্রেট ইংল্যান্ডে রানি ভিক্টোরিয়াকে লেখেন।
এরপর জনহিতৈষী কাজের জন্য রানি ভিক্টোরিয়া জমিদার ফয়জুন্নেসাকে ‘বেগম’ উপাধি দেন।
কিন্তু ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী দুইবার সেই উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়েছিলেন, ‘তার প্রজাদের কাছে এমনিতেই তিনি বেগম হিসেবে পরিচিত, সুতরাং নতুন করে ঐ উপাধির প্রয়োজন নেই’।
এরপর রানি ভিক্টোরিয়ার মনোনীত এক প্রতিনিধিদল এসে অনুসন্ধান করে রিপোর্ট পাঠায় ইংল্যান্ডে। তার ওপর ভিত্তি করে ১৮৮৯ সালে রানি ভিক্টোরিয়া ফয়জুন্নেসাকে ‘নওয়াব’ উপাধি দেন।
কথিত আছে আড়ম্বরপূর্ণ এক সরকারিভাবে আয়োজনের মধ্য দিয়ে সেই উপাধি দেওয়া হয়েছিল। অভিষেক অনুষ্ঠানে তাকে হীরাখচিত একটি পদক, রেশমি চাদর এবং সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।
বাংলাপিডিয়া বলছে, ১৮৭৩ সালে তিনি নারীশিক্ষা প্রসারে প্রথম কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
এটি উপমহাদেশে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীনতম স্কুলগুলোর অন্যতম, এমনকি বাংলায় নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মের আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই স্কুল। বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালে।
পরবর্তীতে ঐ বিদ্যালয়টি কলেজে রূপান্তরিত হয়। ঐ স্কুলটি ছাড়াও হোমনাবাদ এবং লাকসামের বিভিন্ন এলাকায় তিনি স্কুল ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৪টি মৌজা, তার প্রত্যেকটিতে একটি করে মোট ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী।
‘নবাব ফয়জুন্নেসা ও পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ’ বইয়ে বলা হয়েছে, নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী মেয়েদের পড়াশোনায় সহায়তা করার জন্য স্থানীয়ভাবে হোস্টেলের ব্যবস্থা করেছিলেন, যার খরচ বহন করা হত তার জমিদারির আয় থেকে।
এছাড়া পড়াশোনায় উৎসাহ দিতে মেয়েদের জন্য মাসিক বৃত্তিও দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।
এছাড়া এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ, দিঘি-জলাশয় খননসহ নানা ধরণের জনহিতকর কাজে তিনি অবদান রেখেছেন। এলাকায় মসজিদ, মাদরাসা ইত্যাদি নির্মাণেও তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। ১৯০৩ সালে ৬৯ বছর বয়সে তিনি কুমিল্লার লাকসামে মৃত্যুবরণ করেন।
আপনার মতামত জানানঃ