বহু যুগ আগে থেকেই নারীরা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করে আসছেন। পুরুষ প্রধান সমাজে নিজেদের অস্তিত্বের ছাপ রেখে গিয়েছেন বহু নারী।
আজ জেনে নেব এমনই এক নারী শাসকের কাহিনি, যিনি বহুযুগ আগেই পর্দার প্রথার বাইরে গিয়ে পুরুষদের সঙ্গে সমানে সমানে লড়াই করেছেন।
রাজিয়া সুলতানা জন্মগ্রহণ করেন ১২০৫ সালে। প্রচন্ড মেধাবী, পরিশ্রমী আর বুদ্ধিমতী রাজিয়ার ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিলো। যুদ্ধের প্রতিও ছিলো তার প্রচন্ড নেশা। পিতা ইলতুৎমিশ নিজ হাতে তাকে যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল শিখিয়েছিলেন, সাথে রাজনীতিও। রাজনীতি আর যুদ্ধবিদ্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অবস্থা এমন হয়েছিলো যে হেরেমের সাথে তার তেমন কোনো যোগাযোগই ছিলো না। হেরেমের রীতিনীতিও তেমন একটা জানতেন না!
সে যা-ই হোক, ইলতুৎমিশ তার উত্তরাধিকারী হিসেবে কন্যা রাজিয়াকে মনোনীত করে যান। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর একজন নারীর শাসন মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান দরবারের অভিজাতরা। আর তাই ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর তারা ইলতুৎমিশের ছোট পুত্র রাজিয়ার সৎ ভাই রোকনউদ্দীন ফিরোজকে ক্ষমতায় বসান।
রোকনউদ্দীন ফিরোজ ছিলেন চরম অযোগ্য একজন শাসক। ক্ষমতার স্বাদ পেয়েই তিনি ভোগ-বিলাসে ব্যস্ত হয়ে গেলেন, রাজ্য চালনার চেয়ে গায়িকা আর নর্তকীদের সাথে সময় কাটাতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। আর রাজ্য চালাতে লাগলেন তার মা তুরকান খাতুন। ফলে যা হবার তা-ই হলো। অযোগ্য শাসক রোকনউদ্দীন আর তার অনভিজ্ঞ মা তুরকান খাতুনেরর জন্য গোটা রাজ্যে বিশৃঙ্খলা নেমে এলো।
১২৩৬ সালের ৯ নভেম্বর ৪০ জন অভিজাতদের কাউন্সিল চিহালগানি রোকনউদ্দীন ফিরোজকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে রোকনউদ্দীন আর তার মাকে হত্যা করে। রাজ্যের সিংহাসন তখন শূন্য। সুলতানা রাজিয়া এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি দিল্লীর জনগণের সহায়তায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। অন্য কোনো উপায় না থাকায় চিহালগানিও তাকে সে সময়ের জন্য সমর্থন করতে বাধ্য হয়।
নারী হিসেবে যেন কেউ তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে না দেখে, সেজন্য সুলতানা রাজিয়া সিংহাসনে বসতেন পুরুষদের অনুকরণে আলখাল্লা পরে, মাথায় পরতেন পাগড়ি। তিনি তাকে ‘সুলতানা’ সম্বোধন করাটাও পছন্দ করতেন না। কারন, তাঁর মতে ‘সুলতানা’ হচ্ছে ‘সুলতান’ অর্থাৎ শাসকের স্ত্রীর উপাধি। তিনি তো আর শাসকের স্ত্রী না, বরং তিনিই স্বয়ং শাসক। ক্ষমতায় বসে রাজিয়া তাঁর পিতার রাজত্বকাল থেকে চলমান কিছু সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে লাগলেন।
এছাড়াও তিনি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন চিহালগানি তাকে প্রতিটি পদে পদে বাধা দেবে, তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবে। আর তাই সিংহাসনে বসেই তিনি সভাসদদের কাউন্সিল চিহালগানির ক্ষমতার হ্রাস করার চেষ্টা করেন, যার ফলে তিনি চিহালগানির রোষের মুখে পড়ে যান। তাছাড়া দরবারের অনেক অভিজাত আমিরই একজন মহিলার শাসনে থাকতে পছন্দ করছিলো না, যার ফলে ভেতরে-বাইরে সব জায়গাতেই অসন্তোষ দানা বাঁধছিল।
রাজিয়া সুলতানা, তিনি ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক। রাজিয়া সুলতানার পুরো নাম রাজিয়া উদ দুনিয়া ওয়া উদ্দিন। ইলতুৎমিসের কন্যা ছিলেন রাজিয়া। একাধারে একজন ভালো শাসক ও সেনাপতি হওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধ ক্ষেত্রেও অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন তিনি।
ইলতুৎমিসের যোগ্য পুত্র মারা যাওয়ার কারণে রাজিয়াকে দিল্লির শাসক হিসাবে মনোনীত করেন সুলতান। এই কন্যা চিরকালই অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও যুদ্ধবিদ্যায় পটু ছিলেন। তবে সুলতানের মৃত্যুর পরে তার আরেক পুত্র রোকনুদ্দিন ফিরোজ সিংহাসন দখল করে নেন এবং প্রায় সাত মাস শাসন চালান দিল্লির দরবারেষ কিন্তু ১২৩৬ নাগাদ জনগণের সাহায্য নিয়ে ভাইকে অপসারণ করে ফের ক্ষমতায় ফেরেন রাজিয়া।
তবে শুধু শাসনকার্য ও যুদ্ধবিদ্যায় পটু হওয়া ছাড়াও নারীদের জন্য অনেক অবদান রয়েছে রাজিয়ার। শাসনকার্যের স্বার্থে নারীত্বের আবরণ পরিত্যাগ করে, পুরুষের পোশাক গ্রহণ করেন এই রাজিয়া। নারী পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস রাখতেন এই রাজিয়া। এই পোশাকেই তিনি জনসম্মুখে, প্রশাসনে ও যুদ্ধক্ষেত্রে আসতেন।
নারী হয়েও প্রকাশ্যে পর্দাপ্রথার বিরোধী হয়ে শাসনকাজ পরিচালনা করার জন্য উলেমা ও প্রভাবশালী শ্রেণির বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। তাই তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। এইরকমই একটি ষড়যন্ত্র হল চল্লিশ জন ক্রীতদাসদের সমন্বয়ে গঠিত ‘চল্লিশ চক্র’ বা তার্কান-ই-চিহালগানী। ১২৪০ রাজিয়ারই এক বিশ্বস্ত ভৃত্য যে কি-না এই চক্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাকে খাদ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করে।
আপনার মতামত জানানঃ