বাঙালির বংশ পদবি উৎপত্তির ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। মধ্যযুগে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফলে পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমান্তরালে বাঙালির পদবির বিকাশ ঘটেছে বলে মনে করা হয়।
বাঙালির জমি-জমা বিষয় সংক্রান্ত কিছু পদবি যেমন- হালদার, মজুমদার, তালুকদার, পোদ্দার, সরদার, প্রামাণিক, হাজরা, হাজারী, মণ্ডল, মোড়ল, মল্লিক, সরকার, বিশ্বাস ইত্যাদি বংশ পদবি রয়েছে, যা হিন্দু -মুসলমান নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের একান্ত রূপ।
বাঙালি মুসলমানের শিক্ষক পেশার পদবি হলো খন্দকার, আকন্দ, নিয়াজী ইত্যাদি। আর বাঙালি হিন্দুর শিক্ষক পদবি হচ্ছে- দ্বিবেদী, ত্রিবেদী, চর্তুবেদী ইত্যাদি।
এবার আপনাদের জানাবো বাঙালির কিছু বিখ্যাত বংশ পদবি উৎপত্তির ইতিহাস। যেমন- শিকদার, সৈয়দ, শেখ, মীর, মিঞা, গাজী, শহিদ, মোল্লা, দাস, খন্দকার, আকন্দ, চৌধুরী, ভূঁইয়া, মজুমদার, তরফদার, তালুকদার, সরকার, মল্লিক, মন্ডল, পন্নী, ফকির, আনসারী, দত্ত ইত্যাদি।
সৈয়দ পদবি মূলত এসেছে নবী নন্দিনী হজরত ফাতেমা ও হজরত আলীর বংশধর থেকে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এই বংশের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র না থাকলেও বাংলাদেশের অনেক মুসলমান পরিবার সৈয়দ বংশ পদবি ব্যবহার করে নিজেদের সম্ভ্রান্ত ও কুলীন মুসলমান বলে দাবি করে থাকেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে সৈয়দ পদবির অপব্যবহার ও পক্ষেপণ ঘটেছে সবচেয়ে বেশি।
প্রকৃত পক্ষে সৈয়দ নন এবং পারিবারিক কোনো কুলীন পদবিও নেই, অথবা পূর্ব পদবি ঐতিহ্য পরিত্যাগ করতে ইচ্ছুক এমন অনেক বংশ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষে বাংলাদেশে সৈয়দ পদবি আরোপিতভাবে ব্যবহার শুরু করেছিলেন।
শেখ আরবি থেকে আগত পদবি। সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সম্মানসূচক বংশ পদবি শেখ। যিনি সম্মানিত বৃদ্ধ অথবা যিনি গোত্রপ্রধান, তাকেই বলা হতো শেখ। হজরত মোহাম্মাদ (সা.) সরাসরি যাকে বা যাদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, তিনি বা তার বংশ ধরও শেখ নামে অভিষিক্ত হতেন অথবা শেখ পদবি লাভ করতেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে যারা শেখ পদবি ধারণ করেন, তারা এরকম ধারণা পোষণ করেন না যে, তারা বা তাদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন সৌদি আরব থেকে। বাঙালি সৈয়দ পদবি ধারীদের থেকে শেখ পদবিধারীদের এখানে একটা মৌলিক তাৎপর্যগত পার্থক্য রয়েছে।
শেখ পদবি গ্রহণের নেপথ্যে রয়েছে ওই পূর্বোক্ত চেতনা। নবীর হাতে মুসলমান না হলেও বাংলায় ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে যারা নতুন ধর্মকে গ্রহণ করে নেন; নও মুসলমান’ হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে তারাই শেখ পদবি ধারণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের বংশের উত্তর সূরীরাই শেখ পদবি ব্যবহার করে এসেছেন। এমনিতে অন্য ধর্মের লোকের কাছে মুসলমান মানেই শেখ বা সেক। কেউ কেই শেখ কেউ সেক কিংবা কেউ বা শেখ এর রূপান্তর শাইখও ব্যবহার করে থাকেন।
সুলতানি আমলে কয়েকটি মহাল নিয়ে গঠিত ছিল এক একটি শিক। আরবি শিক হলো একটি খণ্ড এলাকা বা বিভাগ। এর সঙ্গে ফারসি দার যুক্ত হয়ে শিকদার বা সিকদার শব্দের উদ্ভব হয়েছে। এরা ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী রাজকর্মচারী। শব্দকোষে যাকে বলা হয়েছে শান্তিরক্ষক কর্মচারী। এরা শিক বন্দুক বা ছড়ি বন্দুক ব্যবহার করতেন বলে শিকদার উপাধী পেয়েছিলেন; সেই থেকে বংশ পরমপরায় শিকদার পদবির বিকাশ ঘটে।
মির বা মীর শব্দটি এসেছে আরবি থেকে। আরবি শব্দ আমীর’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে মীর। সেই অর্থে মীর অর্থ দলপতি বা নেতা, প্রধান ব্যক্তি, সরদার ইত্যাদি। জিতে নেয়া বা জয়ী হওয়া অর্থে মীর শব্দের ব্যবহার হতো। তবে মীর বংশীয় লোককে সম্ভ্রান্ত এবং সৈয়দ বংশীয় পদবিধারীর একটি শাখা বলে গবেষকরা মনে করেন।
মিঞা মুসলিম উচ্চ পদস্থ সামাজিক ব্যক্তিকে সম্বোধন করার জন্য ব্যবহৃত সম্ভ্রম সূচক শব্দ। এক অর্থে সকল মুসলমানের পদবিই হচ্ছে মিঞা। বাঙালি হিন্দুর মহাশয়’ এর পরিবর্তে বাঙালি মুসলমান মিয়া শব্দ ব্যবহার করে থাকে। মিঞা’ শব্দটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। প্রভু বা প্রধান ব্যক্তি বুঝাতেও মিয়া শব্দের প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে গ্রামীণ প্রধান বা সর্দার অর্থের মিঞা পদবি হিসেবে বাঙালি মুসলমান সমাজে ঠাঁই পেয়েছে।
মোল্লা এবং মুন্সী বাঙালির দুটো জনপ্রিয় পদবি। তাদের প্রসার প্রায় দেশব্যাপী। বঙ্গীয় শব্দকোষে মোল্লা শব্দের অর্থ করা হয়েছে মুসলমান পুরোহিত। বস্তুত এভাবে মসজিদে নামাজ পরিচালনার কারণেও অনেকে মোল্লা উপাধি পেয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, মোল্লা হচ্ছে তুর্কি ও আরবি ভাষার মোল্লা থেকে আগত একটি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ জ্ঞানবিশিষ্ট মহাপন্ডিত ব্যক্তি। অন্য অর্থে মুসলিম পন্ডিত বা ব্যবস্থাপক বা অধ্যাপক হলেন মোল্লা।
পরবর্তীকালে মসজিদে নামাজ পরিচালনাকারী মাত্রই মোল্লা নামে অভিহিত হতে থাকেন। এখান থেকেই সাধারণত বংশ পদবি হিসেবে তা ব্যবস্থার হওয়া শুরু হয়। তারা সব জ্ঞানের জ্ঞানী না হওয়া সত্ত্বেও মোল্লা পদবি ধারণ করেন। যার ফলে ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ প্রবাদের উৎপত্তি হয়েছে।
বাঙালি হিন্দু সমাজে দাস বা দাশ বংশ পদবির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। যেসব হিন্দু সম্পদায়ের মানুষ পদবিতে দাশ লেখেন তাদের পেশা ধীবর থেকে এসেছে বলে গবেষকরা মনে করেন। আর যারা দাস লেখেন তাদের পদবি স্রষ্টার ভৃত্য চেতনা থেকে এসেছেন।
মুসলিম সমাজের ফারসি শিক্ষক হিসেবে খোন্দকার বা খন্দকারের পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যদিকে খোন্দকারের পদবি এসেছে সামন্ত সমাজ থেকে পেশাজীবী হিসেবে। সাধারণভাবে খোন্দকার বা খন্দকার অর্থ হচ্ছে কৃষক বা চাষাবাদকারী। মনে করা হয় ফারসি কনদহ‘ এর যার অর্থ কৃষি’সাথেকার যুক্ত হয়ে কনদহকার> খনদহকার>খন্দকার হয়েছে। ভিন্ন মতে, খন্দকারের মূল উৎপত্তি সংস্কৃত কন্দ> খন্দ যার অর্থ ফসল বলা হয়েছে। এই খন্দ এর সঙ্গে কার যুক্ত হয়েও খন্দকার> খোন্দকার হতে পারে।
এবং এতেও পূর্বের খন্দকার’ শব্দের উৎসের অর্থের তারতম্য ঘটছে না। আবার ফারসি ভাষায়, খোন্দকার বলে একটি শব্দ আছে যার অর্থ শিক্ষক। সেখান থেকেও খোন্দকার পদবি আসা বিচিত্র কিছু নয়। অথবা খোন্দকার শব্দের যে ভিন্নভিন্ন অর্থ তার সবগুলো মিলিত তাৎপর্য থেকেই বিভিন্নভাবে খন্দকার পদবির উৎপত্তি হয়েছে।
খন্দকার ও আখন্দ বা আকন সমার্থক। আখন্দ ও আকন নামে যেসব পদবি তাও সম্ভবত খন্দকার পদবিরই রূপভেদ। খন্দকার>আখন্দ> আকন হয়ে থাকতে পারে। আবার ফারসি আখুন্দ থেকেও আখন্দ এসে থাকতে পারে। যার অর্থ শিক্ষক। তবে আকন্দ এসেছে আখন্দ থেকেই।
সংস্কৃত চতুধারী শব্দ থেকে এসেছে বাংলা চৌধুরী শব্দ। এর অর্থ চর্তুসীমানার অন্তর্গত অঞ্চলের শাসক। বাংলাদেশের বেশিরভাগ জমিদারদের পদবি হচ্ছে চৌধুরী। আবার অনেকে মনে করেন চৌথহারী’ যার অর্থ এক চতুথাংশ রাজস্ব আদায়কারী, সেখান থেকে উচ্চারণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে চৌধুরী’। সেদিক থেকে চৌথ আদায়কারী বা রাজস্ব আদায়কারী পদ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার।
বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে, চতুর’ যার অর্থ তাকিয়া বা মসনদ, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর’ (অর্থ ধারক) এবং এই দুয়ে মিলে হয়েছে চৌধরী’ আর তার থেকেই চৌধুরী’। তবে তা মূলত হিন্দি ও মারাঠি শব্দ। জাতি ধর্ম-নির্বিশেষে চৌধুরী বংশ পদবি ব্যবহার করা হয় এদেশে। ব্রিটিশ-ভারতের প্রায় সর্বত্র এ পদবির অস্তিত্ব ছিল। কারণ চৌধুরী ছিল সামন্ত রাজার পদবি।
এই বংশ পদবিটি এসেছে খোদ ভূমির মালিকানা অর্থ থেকে। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় এর মধ্যে এ পদবির প্রচলন আছে। বাঙালি হিন্দু সমাজে যারাই ভৌমিক’ বাঙালি মুসলমান সমাজে তারা ভূঁইয়া’ হিসেবে পদবি ধারণ করেছেন। মূল সংস্কৃত শব্দ ভৌমিক > (প্রাকৃত) ভূমিকা > (বাংলা) ভূঁইয়া > থেকে ভূঁইয়া বা ভূঁঞা এসেছে। প্রাচীন বড় জমিদার বা সামন্ত রাজার উপাধিও ছিল ভূঁইয়া। প্রকৃতপক্ষে কুলীন বংশ পদবিই ছিল তা। আবার যেসব মানুষ আগে স্থান বিশেষে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি ও চাষাবাদের পত্তন করেছেন তারা স্থানীয় জমিদার রাজার কাছ থেকে ভূঁইয়া নামে অভিহিত হয়ে ঐসব জমি জমার স্বত্ব লাভ করেছেন।
মজুমদার পদবি মূল আসলে মজুনদার। এর মূল ফারসি শব্দ হচ্ছে মজমু আনদার। রাষ্ট্রের ও জমিদারির দলিল পত্রাদির রক্ষক রাজকর্মচারীর জন্যে এই পদবি সংরক্ষিত ছিল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র বাংলাদেশে মজুমদার’ পদবির ব্যবহার লক্ষণীয়।
আরবি তরফ’ এবং ফারসি দার’ মিলে তরফদার শব্দের সৃষ্টি। রাজ্যের খাজনা আদায়ের মহালে তদারককারী বা খাজনা আদায়কারীর উপাধি ছিল তরফদার। এই পদবি ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ রাজকার্য পরিচালনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন, সেখান থেকেই এই বংশ পদবি উৎপত্তি ও প্রচলন। অন্যমতে তরফদার তরফের রাজস্ব আদায়কারী লোক; তরফের মালিক; পদবি বিশেষ।
আমাদের দেশে পরিচিত একটি বংশ পদবি। বাংলাদেশে জমিদারির পরই তালুক ভূ-সম্পত্তির একটি বিভাগ। মোগল ও ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব ও ভুমি সংক্রান্ত বিষয়াদি থেকে যেসব পদবির উৎপত্তি ও বিস্তার তার মধ্যে তালুকদার’ হচ্ছে অন্যতম পদবি। তালুক’ শব্দ থেকেও এই পদবির মর্মাথ উপলব্ধি করা সম্ভব। আরবি শব্দ তা’ আল্লুক, যার অর্থ ভূ-সম্পত্তি এবং এর সঙ্গে ফারসি দার যুক্ত হয়ে (তা’আল্লুক+দার) তালুকদার’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, যিনি তালুকদার, তিনি জমি ও ক্ষুদ্র ভূ-সম্পত্তি বন্দোবস্ত নিতেন সরকারের কাছ থেকেও যেমন, তেমনি জমিদারের কাছে থেকেও। ফলে তিনি হতেন উপজমিদার সেই অর্থেই এসেছে তালুকদার’।
সরকার শব্দটি ফারসি থেকে আগত। এর অর্থ প্রভূ, মালিক, ভূস্বামী, শাসনকর্তা, রাজা। অর্থ আদায় ও ব্যয় সংক্রান্ত কর্মচারী ও সরকার। মোগল আমলে এদেশের স্থানীয় রাজকর্মচারীদের এ পদবি দেওয়া হতো। মোট কথা প্রধান কর্মচারী এবং সম্পত্তি দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে সরকার বলা হতো। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই এ পদবির ব্যবহার আছে।
বাংলা শব্দের বিশেষজ্ঞ হরিচরণ বন্দ্যোপধ্যায়ের মতে- ঠাকুর শব্দের মূল হচ্ছে (সংস্কৃত) ঠাক্কুর তার থেকে > (প্রকৃত) ঠকুর > (বাংলা) ঠাকুর এসেছে। পদবিগত দিক থেকে তা ব্রাক্ষণের পদবি বিশেষ, এমনকি ক্ষত্রিয়েরও উপাধি এটি। মধ্য যুগের কাব্য চৈতন্য ভাগবত’ উদ্ধৃত করে লেখক বলেছেন, তা বৈঞ্চবেরও উপাধি। যেমন, হরিদাস ঠাকুর। পাচক ব্রাক্ষণও এক প্রকার ঠাকুর বলে পরিচিত। তবে আহমদ শরীফ সম্পাদিত সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান’ বলছে, সংস্কৃত ঠাক্কুর থেকে ঠাকুর আসলেও এর মূলে ছিল তুর্কি শব্দ। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয়েই এই পদবি ব্যবহার করে।
গাজী শব্দটির উৎপত্তি আরবি গজওয়া হতে। গাজী শব্দের অর্থ যুদ্ধে বিজয়ী বীর। গাজী বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জিহাদে বা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মরে গেলে শহিদ বলা হয়। বিজয়ী হয়ে ফিরে এলে তাদেরকে গাজী উপাধি দেওয়া হতো। এরা মুসলিম সমাজে সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব।
এরকম শতাধিক বংশ পদবি রয়েছে আমাদের দেশে। বাঙালির পদবির ইতিহাস বৈচিত্র পথ ও মতের এক অসাধারণ স্মারক হিসেবে চিহ্নিত। সূত্র: সামহোয়্যারইনব্লগ।
এসডব্লিউএসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ