“সানসিংতুন” এর নাম আগে “সানসিং গ্রাম” ছিল। কেউ ভাবতে পারেন নি যে, ইয়ে নামে একজন কৃষক জমি চাষ করার সময় এমন একটি বিস্ময় আবিস্কার করবেন। তারপর একটানা কয়েক দশকের গবেষণার পর প্রমাণিত হয়েছে, পাঁচ থেকে তিন হাজার বছর আগে এখানে প্রাচীন ‘শু’ রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল।
সুউজ্জল এই সভ্যতা এখানে ২০০০ বছর স্থায়ী ছিল। সানসিংতুন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের ফলে ‘শু’ রাষ্ট্রের ইতিহাস আরো ২০০০ বছর এগিয়েছে। এ আবিষ্কার চীনের সভ্যতার ইতিহাসকে আরো সুসম্পূর্ণ করেছে। সানসিংতুন সভ্যতা আর ছুয়াংচিয়াং নদীর সভ্যতা ও হুয়াংহো নদীর সভ্যতার মতো সবই চীন সভ্যতার মুল ভিত্তি।
সানসিং গ্রাম চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সিছুয়ান প্রদেশে অবস্থিত। রাজধানী চেনতুং থেকে গাড়িতে যেতে প্রায় এক ঘন্টা লাগে। ৭৫ বছর আগেকার বিস্ময়কর আবিষ্কার এই গ্রামের শান্তভাব ভেঙে দিয়েছে। প্রায় দশ বছর আগে এখানে সানসিংতুন নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।
সানসিংতুন জাদুঘরের কর্মী ছিউ শুয়েন ছিং জানিয়েছেন, উত্তর অক্ষাংশের ৩০ ডিগ্রিতে অবস্থিত এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য আছে। তিনি বলেছেন, এই অক্ষাংশে আরো রয়েছে ছুমোলোংমা পর্বত, মায়া সভ্যতা, বারমুদা ত্রিকোণ। এগুলোর অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রহস্য।
সানসিংতুন হচ্ছে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম চীনে আবিষ্কৃত পুরাকীর্তির মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি, আওতায় সবচেয়ে বড়, স্থায়ী সময় সবচেয়ে দীর্ঘ এবং সবচেয়ে সাংস্কৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ একটি প্রাচীন নগর।
প্রত্নতত্ব থেকে জানা গেছে, প্রায় ৩০০০ বছর আগে, এই প্রাচীন নগর আকস্মিকভাবে বাতিল করা হয়। ফলে খুব উন্নত মানের সানসিংতুন সভ্যতা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচ বছর আগে চেনতুং শহরের উপকন্ঠে আবিষ্কৃত কিনশা ধ্বংসাবশেষ আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়েছে।
এই দুটি পুরাকীর্তির বৈশিষ্ট্যে বহু মিল আছে। ফলে কেউ কেউ বলেন, সানসিংতুন বর্তমান কিনশা ধ্বংসাবশেষের জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০০ বছর স্থায়ী একটি সুউজ্জল প্রাচীন নগরকে বাতিল করার আসল কারণ কি ছিল?
কেউ বলেন, বন্যার জন্য। কেউ বলেন, যুদ্ধের জন্য। কেউ বলেন, মহামারী-রোগের জন্য। কিন্তু এ সম্পর্কে কোন ঐতিহাসিক রেকর্ড নেই, সেই জন্য আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে এক গোলক ধাঁধা রয়েছে।
জাদুঘরের কর্মী ছিউ সুয়েন ছিং বলেছেন, ব্রোন্জ দিয়ে তৈরি দ্রব্যাদি হচ্ছে সানসিংতুনে আবিষ্কৃত পুরাকীর্তির মধ্যে সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় জিনিষ। বিশেষ করে কিছু ব্রোন্জ মূর্তির এশিয় ব্যক্তির চেহারার সঙ্গে অনেক ভিন্নতা রয়েছে।
তাদের বড় বড় চোখ, উচু উচু নাকের হাড়। তিনি বিশেষ করে জাদুঘরের একটি ব্রোন্জ দিয়ে তৈরি মুখোশের ব্যাখ্যা করেছেন। জানা গেছে, এটা হচ্ছে শু রাষ্ট্রের প্রথম রাজার আসল মুখের মূর্তি।
তিনি বলেছেন, এটা হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় একটা ব্রোন্জ মুখোশ এবং আমাদের রাষ্ট্রীয় মূল্যবান বস্তু। এই মুখোশের চোখ বেলুনাকার। কান খুব বড় এবং চুড়াযুক্ত। পর্যটকরা তাকে দিব্যদৃষ্টি বা অলোকশ্রবণসম্পন্ন বলে ডাকে।
আরেকটি পুরাকীর্তি থোংটিয়ান গাছ ফরাসি পর্যটক হিমবার্ট দ্রোজকে সবচেয়ে আকর্ষণ করেছে। তিনি বলেছেন, কয়েক বছর আগে এ পুরাকীর্তিগুলো ফ্রান্সে প্রদর্শিত ছিল। যদিও তিনি জানেন, চীনের বহু প্রাচীন ইতিহাস আছে। তবু যখন তিনি আরেক বার এ পুরাকীর্তিগুলো দেখার সুযোগ পান, তখন অবাক হন।
প্রাচীনকালে চীনারা মনে করেন, গাছ হচ্ছে মহামূন্যের অবতার। সূর্য, চাঁদ, তারকা সবই গাছের ফল। ব্রোন্জ দিয়ে তৈরি এই ৩.৬ মিটার উচু থোংটিয়ান গাছ বিশ্বের বিস্ময় বলা হয়।
ম্যাডাম ছিউ শুয়েন ছিং বলেছেন, এই গাছ তৈরির প্রযুক্তি খুব কঠিন। এমন ভাস্কর্য পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। এতো বড় ব্রোন্জ দিয়ে তৈরি দ্রব্যাদি এক বার উৎপাদিত হয় না। আমাদের আবিষ্কৃত আটটি ব্রোন্জ গাছের মধ্যে আমরা মাত্র দুটি গাছকে মেরামত করেছি। একটি গাছ মেরামত করতে তিন বছর সময় লাগে।
বলা যায়, ব্রোন্জ দিয়ে তৈরি দ্রব্যাদি হচ্ছে সানসিংতুনে আবিষ্কৃত পুরাকীর্তির মধ্যে সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বকারী পুরাকীর্তি। এই পুরাকীর্তিতে পুরোপুরি সেই যুগের চমৎকার শিল্প প্রযুক্তির মান প্রতিফলিত হয়েছে।
সানসিংতুন ধ্বংসাবশেষে বিপুল পরিমাণ হাতির দাত আর সামুদ্রিক খোলা আবিষ্কৃত হয়েছে। এটা হচ্ছে সানসিংতুনের আরেকটি রহস্য। কারণ বর্তমান সিছুয়ান প্রদেশের ভৌগোলিক অবস্থা দেখে বুঝা যায়, সেখানে কোন মতে হাতি বেচে থাকার পরিবেশ নেই এবং সমুদ্র থেকেও বহু দূর।
এ বিষয় ছিউ শুয়েন ছিং বলেছেন, কিছু পন্ডিত মনে করেন, হাতির দাত আর সামুদ্রিক খোলা “দক্ষিণ রেশমী পথের” মাধ্যমে এসেছে। আমরা প্রায় ৫০০০টি সামুদ্রিক খোলা আবিষ্কার করেছি। অন্তর্দেশীয় শহর চেনতুয়ে কোন মতে সামুদ্রিক খোলা থাকার কথা নয়।
তা থেকে বুঝা যায়, প্রাচীন শু রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক লাইন সত্যি সত্যি খুব লম্বা, এমন কি পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত ছিল।
সানসিংতুন জাদুঘর প্রতিষ্ঠার দশ বছরে অসংখ্য পর্যটক আকর্ষণ করেছে। সানসিংতুন পুরাকীর্তি আফ্রিকা ছাড়া অন্য চারটি মহাদেশে প্রদর্শিত হয়েছে।
সানসিংতুন জাদুঘরের উপ-প্রধান চাং জি চোং বলেছেন, পর্যটকরা সানসিংতুনের প্রাচীন ও রহস্যময় সংস্কৃতি সবচেয়ে পছন্দ করেন। সানসিংতুনকে চাংচিয়াং নদী সভ্যতার উপরে একটি রাজমুকুট বলা হয়। গভীর প্রাচ্য ও সিছুয়ানের প্রাচীন শু রাষ্ট্রের সভ্যতার মিশ্রন হচ্ছে সানসিংতুনের বৈশিষ্ট্য।
এসডব্লিউএসএস/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ