ইসরায়েলের নজরদারির প্রযুক্তি সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের ভয়ংকর হাতিয়ার বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
প্রসঙ্গত, স্পিয়ারহেড নামের এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আশপাশের প্রায় আধা কিলোমিটারের মধ্যে থাকা এনক্রিপ্টেড হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা, ফেসবুক চ্যাট, যোগাযোগের তালিকা, কল ও টেক্সট মেসেজ সংগ্রহ করা যায়।
সূত্র মতে, এ প্রসঙ্গে আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক দল যেসব দলিল সংগ্রহ করেছে, তার মধ্যে নজরদারী করার প্রযুক্তি ক্রয় করার একটি কন্ট্রাক্ট আছে, যেখানে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছিল ১৮ই জুন, ২০১৮।
পিকসিক্স নজরদারী সরঞ্জামের ম্যানুয়ালে এই যন্ত্রকে ‘ইমসি ক্যাচার’ (IMSI catcher) বা স্টিংরে নামে বর্ণনা করা হয়েছে, এবং বলা হয়েছে যে মোবাইল ফোন ‘মনিটরিং’ হচ্ছে এর কাজ।
এই মেশিন একটি মোবাইল ফোন টাওয়ারের মত কাজ করে, বলছেন এই প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এলিওট বেনডেনেলি। এটা সেল টাওয়ারের মত আচরণ করে। একটি নির্দিষ্ট এলাকার সব মোবাইল ফোন তার সাথে যোগ হবে এবং এই যন্ত্র সব কমিউনিকেশন ইনটারসেপ্ট করতে পারবে।
টেক্সট মেসেজ, ইন্টারনেট; সব ধরনের কমিউনিকেশন ইনটারসেপ্ট করতে পারবে, এবং যে কোন সময় ২০০ থেকে ৩০০ মোবাইল ফোন এক সাথে ইনটারসেপ্ট করতে পারবে।
এই মডেল সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে, যেমন টেক্সট মেসেজের কথা বদলে দিতে পারে, যে ব্যবহার করছে তার পরিচয় বদলে দিতে পারে।
এ কারণেই টিআইবি বলেছে, জনগণের করের টাকায় এমন ভয়ংকর হাতিয়ার কোন সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতি অনুযায়ী কেনা হলো, কী উদ্দেশ্যে, কোন পরিপ্রেক্ষিতে, কার স্বার্থে এর ব্যবহার হবে, এমন মৌলিক প্রশ্নের জবাব জানার অধিকার দেশবাসীর আছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে টিআইবি আরও বলেছে, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অনুপস্থিতিতে এমন প্রযুক্তির ব্যবহারে ব্যক্তিগত তথ্য ও যোগাযোগের গোপনীয়তা, সুরক্ষা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ একাধিক সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার খর্ব হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ইসরায়েলের সাবেক এক গোয়েন্দা কমান্ডার পরিচালিত কুখ্যাত কোম্পানি থেকে নজরদারির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কেনে বাংলাদেশ, যা গত বছরের জুনে বাংলাদেশে পৌঁছায়।
এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘জনগণের ব্যক্তিগত তথ্য ও যোগাযোগের গোপনীয়তা, সুরক্ষা, বাক্ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয় এবং সর্বোপরি ব্যক্তির জীবন ও জীবিকার জন্য হুমকি হতে পারে, এমন প্রযুক্তি কেনা ও ব্যবহারের বিস্তৃতি ও পরিধি সম্পর্কে সরকারের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা জানার অধিকার দেশবাসীর আছে।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘ইসরায়েল থেকে সরাসরি কিছু কেনা হয়নি—সরকারের এমন ব্যাখ্যার অর্থ এই নয় যে এই ইসরায়েলি প্রযুক্তি আমদানি করা হয়নি। প্রকাশিত সংবাদে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, ইসরায়েল ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় সাইপ্রাসের মাধ্যমে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই কেনাকাটা সংঘটিত হয়েছে।
এমনকি এই প্রযুক্তি পরিচালনা বিষয়ে শিখতে এনটিএমসির কমান্ডার ও অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ২০২১ ও ২০২২ সালে গ্রিস সফর করেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। এ তথ্য মিথ্যা হলে তা প্রমাণ করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারের। সর্বোপরি এই প্রযুক্তি যে সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সির হাতে ইতিমধ্যে এসেছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘গত কয়েক বছরে রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, গণমাধ্যমকর্মী এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় এটা এক রকম নিশ্চিত করে বলা যায় যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ এক বা একাধিক বিশেষায়িত সরকারি সংস্থা নজরদারির বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু সরকারের তরফে কখনোই এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি।
আপাতদৃষ্টে এমনটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে ক্ষমতাসীন মহল এ ধরনের নজরদারির প্রযুক্তি যথেচ্ছ ব্যবহার করছে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিরাপত্তা, বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানহানিসহ সংবিধানে নিশ্চিত করা অধিকার ক্ষুণ্ন করছে।
সুতরাং এ ব্যাপারে রাখঢাক না করে উল্লিখিত প্রশ্নাবলির উত্তরসংবলিত একটি সুনির্দিষ্ট নীতিকাঠামো প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে জনস্বার্থ পদদলিত করে বাংলাদেশকে অবিলম্বে সম্পূর্ণভাবে নজরদারিভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিগণিত করা হবে।’
টিআইবি মনে করে, এ পর্যন্ত নজরদারির প্রযুক্তি ব্যবহারের যেসব উদাহরণ দেশবাসীর সামনে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে শুধু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলে দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে সব অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণীত হওয়ার আগে এই প্রযুক্তি ব্যবহার স্থগিত রাখার কোনো বিকল্প নেই।
এসডব্লিউএসএস/১২৪০
আপনার মতামত জানানঃ