আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের একটি শিক্ষাকেন্দ্রে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কাবুল পুলিশ জানিয়েছে, এতে অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছেন এবং অনেকে আহত হয়েছেন। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি শুক্রবার(৩০ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাবুলের পশ্চিমাঞ্চলের বারচি এলাকার একটি শিক্ষাকেন্দ্রে আজ শুক্রবার এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলেছেন, শিক্ষার্থীরা সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় বসেছিলেন। এখন পর্যন্ত কোনো গোষ্ঠী এ হামলার দায় স্বীকার করেনি।
কাবুল পুলিশে মুখপাত্র খালিদ জর্দান সিএনএনকে বলেন, কাজ নামের শিক্ষাকেন্দ্রে দেশটির স্থানীয় সময় শুক্রবার সকাল ৭ টা ৩০ মিনেটে এই আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটে। সেই সময় শিক্ষার্থীরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা দিচ্ছিলো।
ওই এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে বেশির ভাগই সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের। এর আগেও এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হামলার শিকার হয়েছিল।
স্থানীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত ভিডিও ও ছবিতে দেখা গেছে, ঘটনাস্থল থেকে হতাহতের দেহ সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
তালিবানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল নাফি টাকোর বলেছেন, নিরাপত্তা বাহিনী ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। তিনি এ হামলার তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করা অমানবিক নিষ্ঠুরতা এবং এটি তাদের (শত্রুদের) নৈতিক মানদণ্ডের অভাবই প্রমাণ করে।
গত বছররে আগস্টে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে তালিবান গোষ্ঠী। এরপর থেকে তারা দেশটিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এ অঞ্চলে বেশির ভাগ সময় ইসলামিক স্টেট গ্রুপ হামলার ঘটনা ঘটিয়ে থাকে।
তালিবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আফগানিস্তান জুড়ে সামগ্রিক সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেলেও কাবুল এবং অন্যান্য শহরে নিয়মিত বোমা হামলা হয়েছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে রুশ দূতাবাসের বাইরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় দূতাবাসের দুই কর্মী নিহত হয়েছিল।
কাজ নামের শিক্ষাকেন্দ্রে দেশটির স্থানীয় সময় শুক্রবার সকাল ৭ টা ৩০ মিনেটে এই আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটে। সেই সময় শিক্ষার্থীরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা দিচ্ছিলো।
গত বছর তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে শিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষ। পাশাপাশি হাজারা, তাজিক, উজবেকসহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপরও ক্রমাগত হামলার ঘটনা ঘটছে।
বর্তমানে হাজারাদের নতুন শত্রু আইএস। পথে, বাসে, প্রতিষ্ঠানে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে হামলা চালাচ্ছে তারা। চারদিক থেকে নির্যাতনের শিকার হাজারা সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে।
তালিবানের ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন আফগানিস্তানে বসবাসরত শিয়া মতাবলম্বী হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের শঙ্কা ছিল, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ শাসনামলের মতো যদি তারা আবার জাতিগত নিগ্রহের শিকার হয়! তাদের শঙ্কাই যেন তালিবানের সাথে বাস্তবে ফিরে এসেছে।
আফগানিস্তানের প্রতাপশালী পশতুন জনগণ হাজারাদের কখনো তাদের সমতুল্য মনে করতে পারেনি। হাজারারা শিয়া। পশতুনরা সুন্নি। ধর্মকেন্দ্রীক এ মতভেদ এবং হাজারাদের নিজস্ব জীবন ব্যবস্থার কারণে কখনো আফগানিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারেনি সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়।
বেসামরিক সরকার হাজারাদের কথা শোনার চেষ্টা করলেও ১৯৯০-এর দশক থেকে জঙ্গিদের কিলিং মিশনের টার্গেটে পরিণত হয় হাজারারা। তালিবান থেকে শুরু করে যেকোনো সুন্নি উগ্রবাদীরা হাজারাদের মুসলমান মনে করে না।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তালিবান কমান্ডার মাওলানা মোহাম্মদ হানিফ সমবেত সুন্নি জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘হাজারারা মুসলিম নয়, তাদের হত্যা কর।’ এরপর তাদের ওপর চরম নিপীড়ন চলতে থাকে। তালিবান সরকারের সময় হাজারাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
হত্যা-নির্যাতনের ভয়ে অনেক হাজারা শিয়াপ্রধান দেশ ইরানে পালিয়ে যায়। আর যারা মাটির মায়া ছাড়তে না পেরে থেকে যায়, তাদের ভাগ্যে জোটে নির্মম অত্যাচার। ১৯৯৮ সালে মাজার-ই শরিফে ষড়যন্ত্র করে কয়েক হাজার হাজারাকে হত্যা করা হয়। তালিবান ও আল-কায়েদার জঙ্গিরা সুযোগ পেলে হাজারাদের রক্তে হাত রাঙাতে দ্বিধা করে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত জঙ্গিপ্রবণ আফগানিস্তানে হাজারারা নিষ্পেষিত— এ কথা প্রমাণ দিয়ে বলা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে আসলে কারা সুরক্ষিত? কেউ নয়। জোর দিয়ে বলা যায়, যত দিন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ না হবে, ততদিন শান্তি ফিরবে না আফগান মুল্লুকে। আর ততদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না হাজারারা। ফলে শান্তির জন্য আফগানিস্তানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বহু বিভক্ত আফগানিস্তানে সেই সম্প্রীতি কবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ