নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, ফলে টাকা পাচারের প্রবণতা বাড়ে বলে মনে করেন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। কাঠামোগত সংস্কার না হলে এটি ঠেকানো সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মঙ্গলবার অর্থনৈতিক বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম বা ইআরএফ-এর নিয়মিত ডায়ালগ অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।
প্রায় দুই ঘণ্টার প্রাণবন্ত আলোচনায় অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন তিনি।
দেবপ্রিয় বলেন, ‘অর্থনীতির রোগ নির্ণয় হয়েছে। এবং এ বিষয়ে ঐকমত্যও আছে। এখন দরকার নিরাময়। কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, তার উপায় খুঁজে বের করা জরুরি। এ জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।’
এ মুহূর্তে জিডিপি সংযত করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাই প্রধান কাজ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির মূল সমস্যা আর্থিক খাত, তথা রাজস্ব ব্যবস্থাপনা। টাকার অভাবে জ্বালানিতে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দিতে পারছে না সরকার। অথচ, আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিয়ে মেতে আছি।
‘আমি বলব, উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে দরিদ্র সরকার। সংকট মোকাবিলায় রাজস্ব আহরণে বেশি মনোযোগ দিতে হবে সরকারকে।’
গত এক দশকে বাংলাদেশের অনেক সাফল্য আছে বলে মন্তক্য করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘এ সময় নিম্ন আয় থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, এলডিসির তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ে বড় উলম্ফন এবং ভৌত অবকাঠামো খাতে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। তবে এই সাফল্যের পাশাপাশি অর্থনীতিতে নানা বিচ্যুতি হয়েছে।‘
আমাদের অর্থনীতির মূল সমস্যা আর্থিক খাত, তথা রাজস্ব ব্যবস্থাপনা। টাকার অভাবে জ্বালানিতে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দিতে পারছে না সরকার। অথচ, আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিয়ে মেতে আছি।
ড. দেবপ্রিয় চার ধরনের বিচ্যুতির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, আমাদের যে জিডিপি হয়েছে, তা মূলত সরকারি খাতের বিনিয়োগ নির্ভর। ব্যক্তি খাতে তেমন বিনিয়োগই হয়নি। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টিকে এভাবে বলা যায়: প্লেন এক ইঞ্জিন দিয়ে চলছে, দ্বিতীয় ইঞ্জিন নেই। ফলে এই প্লেন বেশি দূর যেতে পারবে না।
‘দ্বিতীয়ত বিচ্যুতি হচ্ছে, আর্থিক খাতে দুর্বলতা। জাতীয় আয় বেড়েছে, অথচ রাজস্ব আহরণ সেভাবে হয়নি। বিশেষ করে প্রত্যক্ষ করে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে। আয় কম, ব্যয় কম। ফলে ঘাটতিও কম।
‘তৃতীয় বিচ্যুতি ভৌত অবকাঠামো খাতকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সেভাবে হয়নি। ২০ মেগা প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে জিডিপি ২ শতাংশ। অথচ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপির এক শতাংশের নিচে। মূলত, রাজনৈতিক ফায়দার কারণে সরকার অবকাঠামো উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছে।
চতুর্থত, সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ খুবই কম।’
ড. দেবপ্রিয় মনে করেন, অর্থনীতিতে এসব বিচ্যুতি শুরু হয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল থেকে। তারা প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারেনি। বিশেষ গোষ্ঠীদেরকে সুবিধা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘প্রতিযোগিতাসক্ষম মেধাভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানসম্মত বেসরকারি খাত গড়ে না তুলতে পারলে টেকসই উন্নয়ন হবে না।’
দেবপ্রিয় বলেন, ‘আমরা দেখেছি, কীভাবে বিদ্যুৎ খাতে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়া হয়েছে। এখন এলএনজির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। এভাবে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়ে অর্থনীতিতে বিচারহীনতার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। অতি মূল্যায়িত উন্নয়ন প্রকল্পে একই সুবিধা দেয়া হয়েছে, যার দায় এসে পড়েছে জনগণের উপরে।’
সিপিডির এ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বাংলাদেশে অর্থনীতিতে প্রারম্ভিক লুণ্ঠন শুরু হয় আশির দশকে। শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা গঠন করে বেনামে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ বিতরণের মধ্য দিয়ে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতির সূচনা হয়, যা আজও অব্যাহত আছে।
তিনি মনে করেন, লুণ্ঠনের আরেকটি উৎস পুঁজিবাজার। এখানে অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। তৃতীয় লুণ্ঠন হচ্ছে অতিমূল্যায়িত সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেয়া। ফলে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে খেটে খাওয়া উদ্যোক্তা শ্রেণি খুবই কম বলে মনে করেন তিনি।
গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকলে, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হয় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি বৈষম্য বাড়ে, তার সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা যুক্ত হয়, তাহলে সামাজিক অসন্তোষ তৈরি হয়।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগামী দুই-তিন মাস মাসের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে যারা মন্তব্য করেছেন, তাদের ধারণা ঠিক নয়। এ ধরনের মন্তব্যে বাজারে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আগামী ২০২৪ সালের আগে পরিস্থিতির স্বাভাবিক হবে না।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৪
আপনার মতামত জানানঃ