বিভিন্ন সময়ে রাশিয়া ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ইতালির তিন রাজনৈতিক নেতা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন। এতে পতন ঘটেছে প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাগি নেতৃত্বাধীন সরকারের। জ্বালানিসহ নানাবিধ সংকটের মুখে রয়েছে ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। এই সময়ে ইতালিতে এই সরকার পতন ও এর সম্ভাব্য ফলাফল বিশ্ব রাজনীতির জন্য গুরুতর বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার ইতালির ক্ষমতাসীন জাতীয় ঐকমত্যের সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেয় তিন শরিক দল ফাইভ স্টার মুভমেন্ট, ফোরজা ইতালিয়া ও লিগ। এরপর পদত্যাগের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাগি। ভেঙে যায় সরকার। সরকারের পতনের পর আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর ইতালিতে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে।
এর আগ পর্যন্ত দেশটিতে বাড়তে থাকা জ্বালানিসংকট, মূল্যস্ফীতি, করোনার নতুন ঢেউ এবং ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়ার মধ্যে দিন দিন গভীর হতে থাকা ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সামাল দিতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে।
এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের মহামারি-পরবর্তী পুনরুদ্ধার তহবিল (নেক্সট জেনারেশন ফান্ড) থেকে ২১৪ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার বরাদ্দ পেয়েছিল দ্রাগি সরকার। সরকারের পতনের ফলে এখন ওই অর্থ পেতে বিলম্ব হতে পারে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ইতালি সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে ইউরোপে চলমান গ্যাস-সংকট নিয়েও। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর গ্যাসের জন্য মস্কোর ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে বিকল্প উৎসের ব্যবস্থা করেছিল দ্রাগি সরকার। আলজেরিয়া থেকে গ্যাসের বাড়তি সরবরাহ আসা শুরু করেছিল ইতালিতে। এই গ্যাস ইতালি হয়ে আরও উত্তরে জার্মানিতে সরবরাহ করার কথা ছিল। তবে দ্রাগি না থাকায় এখন ইতালির জ্বালানির ভবিষ্যৎও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
ইতালিকে সংকটের মুখে ফেলে মারিও দ্রাগির এই পতন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য বড় জয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। ইতালি ও ইউরোপে পুতিনের প্রভাবে রাশ টানতে বড় ভূমিকা পালন করেছেন দ্রাগি। অন্যদিকে তাঁর নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের যে তিন নেতার কারণে আজ ইতালিতে এই রাজনৈতিক সংকট, অতীতে তাঁদের কাছ থেকে বড় সমর্থন পেয়ে এসেছেন পুতিন।
ওই তিনজনের একজন দ্রাগিকে সমর্থন না জানানো ফাইভ স্টার মুভমেন্টের প্রধান গুইসেপ্পে কন্তে। ২০১৮ সালে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৮-এ রাশিয়াকে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন কন্তে। এমনকি রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পক্ষে বলেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলের সময় থেকেই মস্কোর সঙ্গে কন্তের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
পুতিনের প্রতি লিগের নেতা মাত্তেও সালভিনির সমর্থনেও কোনো রাখঢাক নেই। ২০১৭ সালে তাঁর নেতৃত্বে পুতিনের রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির সঙ্গে একটি আনুষ্ঠানিক সহযোগিতা চুক্তি করে লিগ। পরে ২০১৯ সালে এসে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম অভিযোগ তোলে, রাশিয়া থেকে অর্থ নিতে ওই চুক্তি করেছিল লিগ। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন সালভিনি ও পুতিনের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন। আন্তর্জাতিক ওই দুর্নীতির বিচারিক তদন্ত চলছে।
দ্রাগিকে সমর্থন না দেওয়া ফোরজা ইতালির প্রধান সিলভিও বেরলুসকোনি পুতিনের দীর্ঘদিনের বন্ধু। তাঁরা দুজন এর আগে নিজেদের অবকাশকালীন বাসভবনে দেখা করেছেন। চলতি শতকের শুরুর দশকে বেরলুসকোনি যখন ইতালির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন পুতিন। এমনকি দুই নেতার যৌথ বাণিজ্যিক স্বার্থও রয়েছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর এ বিষয়ে ফোরজা ইতালির নেতা মাত্তেও সালভিনির বিবৃতিও ছিল অস্পষ্ট। তিনি হামলার জন্য রাশিয়াকে সরাসরি দায়ী না করে ‘সব সামরিক আগ্রাসন’-এর নিন্দা জানান। পরে অবশ্য সমালোচনার মুখে পড়ে স্বীকার করতে বাধ্য হন, ‘রাশিয়া ভুল করেছে’। এরপরও হামলার সঙ্গে পুতিনের নাম খুব কমই জড়িয়েছেন। ইউক্রেনে হামলার দেড় মাস পর এসে বলেছেন, ‘ভ্লাদিমির পুতিনের আচরণে তিনি গভীরভাবে দুঃখিত ও হতাশ।’
রাশিয়ার হামলার নিন্দা জানিয়ে কন্তে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। তবে ইতালি থেকে ইউক্রেনে আরও অস্ত্রসহায়তা পাঠানোর বিরোধিতা করেছেন তিনি। ইতালির অনেক নাগরিকের মনোভাবও একই। কন্তের এই বিরোধিতা রাশিয়ার প্রতি তাঁর সমর্থনকেই ইঙ্গিত করছে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, পুতিনের ঘনিষ্ঠ তিন নেতার অসমর্থনে মারিও দ্রাগির পতন নিঃসন্দেহে রুশ নেতার জন্য জয় এবং তাঁর জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। তবে পুতিনের জন্য মূল জয়টা তখনই আসবে, যখন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা ও দলগুলো জয়ী হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫৩
আপনার মতামত জানানঃ