ঢাকা শহর কতটা নিরাপদ? নগরবাসীর কতটা নির্ভয়ে চলতে পারে? এসব ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সূচকে রাজধানী ঢাকার অবস্থান ভালো নয়। নিরাপত্তার দিক থেকে বিশ্বের নগরগুলোর মধ্যে এবার রাজধানী ঢাকা তিন ধাপ যদিও এগিয়েছে। কিন্তু এখনও তালিকার তলানিতেই তার অবস্থান।
চলতি বছরে বাসযোগ্য শহরের এই তালিকা তৈরি করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। তালিকায় ১৭২টি শহরের মধ্যে ১৬৬তম স্থানে আছে ঢাকা। সম্প্রতি এই তালিকা প্রকাশিত হয়েছে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ‘বাসযোগ্য শহরের বৈশ্বিক তালিকা ২০২২’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাসযোগ্য শহরের তালিকার শেষের ১০টি শহরের মধ্যে রয়েছে ঢাকা। তবে গত বছরের র্যাঙ্কিংয়ের সঙ্গে তুলনা করলে ঢাকার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ৩ ধাপ এগিয়েছে ঢাকা।
আগের বছরেও তলানিতেই ছিল ঢাকা। গত বছর বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৭তম, তালিকার নিচের দিক থেকে যা ছিল চার নম্বরে। এবার ঢাকা উঠে এসেছে সাত নম্বরে।
কোন শহর কতটা বাসযোগ্য তা বোঝার জন্য স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো— এই পাঁচ মানদণ্ডে বিচার করে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।
বিশ্বের সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার নাম।
বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের কারণে কিয়েভকে এ বছর এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও রাশিয়ার শহর মস্কো ও পিটার্সবার্গ এ তালিকায় স্থান পেয়েছে।
গত বছর বাসযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে ছিল নিউজিল্যান্ডের শহর অকল্যান্ড। এ বছর সে স্থান দখল করেছে ভিয়েনা। অন্যদিকে অকল্যান্ড চলে গেছে ৩৪তম অবস্থানে। আর ভিয়েনা ১২তম অবস্থান থেকে উঠে এসেছে শীর্ষে।
পাঁচটি মানদণ্ড বিবেচনায় নিয়ে এ তালিকা করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। মানদণ্ডগুলো হচ্ছে স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো। মোট ১০০ সূচকের মধ্যে ঢাকার এবারের স্কোর ৩৯ দশমিক ২, গত বছর যা ছিল ৩৩ দশমিক ৫।
বসবাসযোগ্য শীর্ষ ১০টি শহরের মধ্যে ৬টিই ইউরোপের। ভিয়েনা ছাড়া অন্য শহরগুলো হচ্ছে, ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন, সুইজারল্যান্ডের জুরিখ ও জেনেভা, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম।
এ ছাড়া শীর্ষ ১০-এ রয়েছে কানাডার ক্যালগারি, ভাঙ্কুভার ও টরন্টো, জাপানের ওসাকা এবং অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন।
বাসযোগ্য শহরের তালিকায় একেবারে তলানিতে রয়েছে সিরিয়ার দামেস্ক। শহরটির অবস্থান ১৭২তম। এর আগে রয়েছে নাইজেরিয়ার লাওস, লিবিয়ার ত্রিপলি, আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, পাকিস্তানের করাচি এবং পাপুয়া নিউনিগির পোর্ট মোরসবি। গত বছরও তলানিতেই ছিল দামেস্ক।
এখানে উন্নয়নের নামে বেশুমার অর্থ ব্যয় হয় ঠিকই, তবে সে অনুযায়ী উন্নয়ন দেখা যায় না। মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ঢাকার এই করুণ দশা। দক্ষ নেতৃত্বের অভাব আর ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতার কারণেই কোনো পরিকল্পনাই পুরোপুরি আলোর মুখ দেখেনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগের তুলনায় ঢাকার তিন ধাপ অগ্রগতির মানে এই নয় যে ঢাকা শহরের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ও বাসযোগ্যতার উন্নয়ন ঘটেছে। বরং এর উল্টোটাই ঘটেছে। ঢাকা শহরের পরিবেশগত নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, যানজট ও আবাসন সমস্যা নিরসনসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তার বড় কারণ ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন।
দুঃখজনক বিষয় হলো, রাজধানী ঢাকা গড়ে উঠেছে একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অনেক কিছুই এখানে অনুপস্থিত। ঢাকা ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এর আগে অন্য জরিপে প্রকাশ পেয়েছে ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর করুণ অবস্থাই এ জরিপের সত্যতা প্রমাণে যথেষ্ট।
তারা বলেন, ঢাকায় সুউচ্চ অট্টালিকার সংখ্যা বাড়ছে। উড়াল সড়কও হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু ঢাকার জীবনযাপন সুগম ও সুন্দর হয়েছে বলে মনে হয় না। এ নগরীতে পানিদূষণ ও বায়ুদূষণের ফলে নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। ক্ষতিকর বায়ু গ্রহণ করেই এ শহরে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ভারী ধাতুর দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অতিমাত্রায় শব্দদূষণ নগরবাসীকে মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে। বিল্ডিং কোড না মেনে ও অপরিকল্পিতভাবে ভবন গড়ে তোলার ফলে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপক ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী ঢাকা।
বস্তুত এ শহরের সুনির্দিষ্ট কোনো চরিত্র নেই। যে যেখানে পারছে যেকোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এতে নগরী তার বিশিষ্টতা হারাচ্ছে। ফলে অনেক নাগরিক সুবিধা থেকেই তারা বঞ্চিত হচ্ছে। টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে শহরবাসীর জন্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যানজটের কারণে নগরবাসীর প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা।
তারা বলেন, যানবাহন ও কল-কারখানার কালো ধোঁয়া, খাদ্যে ভেজাল, সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিম্নমানও ঢাকার জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অধিক জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ এ শহরে নেই পয়োনিষ্কাষণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা। বাতাসে সিসা, খাদ্যে ভেজাল, গ্যাস ও পানির সমস্যা বহুদিন ধরে চলে আসছে। গণপরিবহন বলতে যা বোঝায়, ঢাকায় তা নেই। উচ্চ খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া গেলেও তার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। গুটিকতক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা এখানে অনুপস্থিত। মাঠ ও পার্কগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে।
এখানে উন্নয়নের নামে বেশুমার অর্থ ব্যয় হয় ঠিকই, তবে সে অনুযায়ী উন্নয়ন দেখা যায় না। মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ঢাকার এই করুণ দশা। দক্ষ নেতৃত্বের অভাব আর ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতার কারণেই কোনো পরিকল্পনাই পুরোপুরি আলোর মুখ দেখেনি।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু ঢাকা নয় দেশের অন্যান্য শহরকেও পরিকল্পনামাফিক গড়ে তুলতে হবে। সুষম উন্নয়ন করতে হবে গ্রামেও। শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ