প্রায় প্রতিটি বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন বর্তমানে একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার ধরনটাও পাল্টে গেছে। পরীক্ষার আগে পড়াশোনা করার চেয়ে তারা বেশি ব্যস্ত ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের খোঁজে।
প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ, মিছিল প্রভৃতি অরাজকতা। উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলেও দুর্নীতিতে শীর্ষে অবস্থান করছি আমরা, যা একটি জাতির জন্য অত্যন্ত অপমানজনক।
দেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, আর্থিক কেলেঙ্কারি এখন আর নতুন কিছু নয়। আশঙ্কার বিষয় হল, বর্তমান প্রজন্ম কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে শিক্ষাজীবনেই দুর্নীতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে দুর্নীতির এক অভিনব পদ্ধতি প্রশ্নপত্র ফাঁস।
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের আরও সাত-আটজনের নাম বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে একজন বিসিএস কর্মকর্তার নামও রয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁস চক্রের একজনকে গ্রেপ্তার করলেও বাকিদের আইনের আওতায় আনতে ধীরগতিতে এগোচ্ছে পুলিশ।
এদিকে, মাউশির পরীক্ষা বাতিলের চিন্তাও আছে। দু-একদিনের মধ্যে এই ঘোষণা আসতে পারে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বণ্টনে কর্তৃপক্ষ পাঁচটি কমিটি গঠন করেছিল। তার মধ্যে দুটি কমিটির সদস্যরা প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ছিল— এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া মাউশির দু’জন উচ্চমান সহকারীকেও খোঁজা হচ্ছে। তারা হলেন আহসান হাবিব ও নওশাদ। জালিয়াতির ঘটনায় তাদের বড় ধরনের ভূমিকা ছিল।
তদন্তে উঠে এসেছে, পরীক্ষার অন্তত দুই ঘণ্টা আগে প্রশ্ন ফাঁস হয়। অনেকের প্রবেশপত্রে ৭০ নম্বরের উত্তর লেখা ছিল। এরই মধ্যে সুমন জোয়াদ্দার নামে যাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি, তার প্রবেশপত্রেও প্রশ্নের উত্তর লেখা ছিল।
মাউশি মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, পুলিশের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেব। আমরা পুলিশকে বলেছি, যেন এর শিকড় সন্ধান করা হয়।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে— এর সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত আমরা পেয়েছি। যারা প্রশ্নপত্র বিতরণ কমিটিতেও ছিলেন, তাদের কয়েকজন এর সঙ্গে জড়িত। মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাতে বঞ্চিত না হন, এটা নিশ্চিত করতে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো জরুরি।
ডিবির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি ওয়াহিদুল ইসলাম জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, এই চক্রের আরও কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। এটাও নিশ্চিত হওয়া গেছে, অন্তত দুই ঘণ্টা আগে প্রশ্ন ফাঁস হয়। কেন্দ্রে নেওয়ার পথে অথবা কেন্দ্রে পৌঁছার পর প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে।
এই চক্রের আরও কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। এটাও নিশ্চিত হওয়া গেছে, অন্তত দুই ঘণ্টা আগে প্রশ্ন ফাঁস হয়। কেন্দ্রে নেওয়ার পথে অথবা কেন্দ্রে পৌঁছার পর প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে।
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষক আবদুল খালেক বাদী হয়ে মামলা করেন। এজাহারে তিনি বলেন, বিকেল ৩টায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পরীক্ষা শুরু হয়।
তবে পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সুমন জোয়াদ্দার স্বীকার করেন, তার হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দুপুর ২টা ১৮ মিনিটে তার কাছে উত্তরপত্র আসে। এটি পাঠিয়েছেন পটুয়াখালীর সাইফুল ইসলাম ও টাঙ্গাইলের খোকন। অভিযুক্ত সাইফুল পটুয়াখালীর কলাপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক।
শুক্রবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে ঢাকার ৬১টি কেন্দ্রে পরীক্ষা হয়। ৫১৩টি পদের জন্য পরীক্ষার্থী ছিলেন ১ লাখ ৮৩ হাজার।
এদিকে, ঢাকার সিএমএম আদালতের দৈনন্দিন কার্যতালিকাসহ বিচারসংক্রান্ত নিবন্ধন খাতার তথ্য পর্যালোচনা করে জানা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ পাবলিক পরীক্ষায় অপরাধের ঘটনায় করা মামলার বেশির ভাগই প্রমাণ করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। গত ১৩ বছরে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে করা ৪৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১টির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, শতকরা হিসাবে ২ দশমিক ২২ ভাগ। অর্থাৎ ৯৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ মামলার আসামিরা অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন।
২০০৯ থেকে ২০২১ সাল—এই ১৩ বছরে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় মোট ২০০টি মামলা হয়। এসএসসি, এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি, বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার (ব্যাংক, বিসিএস ইত্যাদি) প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ পরীক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগে এসব মামলা হয়। এগুলোর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৫টি মামলার। মাত্র একটি মামলায় এক আসামির পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হয়েছে।
কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদন্তে দুর্বলতা, ‘ভুল আইনে’ মামলা ও অভিযোগপত্র দেওয়া, সাক্ষীকে হাজির না করায় আসামিরা অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন।
পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনটি ১৯৮০ সালের। প্রশ্নপত্র ফাঁস, বইপত্র কিংবা যান্ত্রিক উপায়ে পরীক্ষার্থীকে সহায়তা করা, অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেওয়া, ভুয়া সার্টিফিকেট বানানো ও পরীক্ষায় বাধা দেওয়ার মতো অপরাধে এ আইনে মামলা করা হয়। তবে গত কয়েক বছরে ডিজিটাল মাধ্যম (ডিভাইস ও অ্যাপস) ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনেও মামলা হয়েছে। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা হচ্ছে। এ দুটি আইনে করা মামলাগুলো ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও ঢাকার সিএমএম আদালতে বিচারাধীন।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নতুন নয়। পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর আসছে সংবাদমাধ্যমে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি দুরারোগ্য ব্যাধির মতো জেঁকে বসেছে। কোনোভাবেই এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি প্রেসের কর্মী থেকে শুরু করে ছাত্র-শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা অনেকেই এই চক্রের সঙ্গে জড়িত।
এ বিষয় শিক্ষাবিদেরা বলছেন, অবিলম্বে প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে না পারলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে, মেধাহীন হবে জাতি। তারা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসের কারণে একদিকে যেমন দুর্বল মেধার শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে যোগ্য লোক বঞ্চিত হচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত ফল ও চাকরি থেকে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মেধাবীরা কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়ায় তাদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। তাদের অনেকের নৈতিক স্খলন হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এদের একটি বড় অংশ হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে মাদকে। এই করুণ পরিণতি এখনি ঠেকাতে না পারলে ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
তারা বলেন, প্রশ্নফাঁস ঘটনার সঙ্গে আমাদের নৈতিক বিষয়টি জড়িত। সমাজে অনৈতিকতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এটাই তার প্রমাণ। এখন প্রশ্নফাঁস হলে আগে মা-বাবাও দৌড়ান ফাঁস হাওয়া প্রশ্ন যোগার করার জন্য। সন্তানও মা-বাবাকে দ্বিধাহীনভাবে বলছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যোগার করে দিতে। কারণ প্রশ্ন যোগার করতে না পারলে তার সন্তানও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। যে বাবা মা সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দিবে সে বাবা মা যদি সন্তানকে অনৈতিক সুবিধা দিতে কাজ করেন তাহলে আমাদের সমাজ নৈতিকতা শিখবে কিভাবে? এই যে চিত্রটা এটা জাতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১০
আপনার মতামত জানানঃ