মহামারি করোনার ধাক্কায় ৩০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মানব উন্নয়নে নিম্নমুখী হয়েছে বিশ্ব। আর এর ছোবলে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো চরম দরিদ্র লোকের সংখ্যা বেড়েছে। এই অঞ্চলের ৯ কোটি মানুষকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে এই মহামারি।
ম্যানিলাভিত্তিক সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে এ উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। ‘বিল্ডিং ফরওয়ার্ড টুগেদার: টুওয়ার্ডস অ্যান ইনক্লুসিভ অ্যান্ড রেজিলিয়েন্ট এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি সোমবার প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারি করোনাভাইরাস বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঞ্চল এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে (আগের এশিয়া অঞ্চল) দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করেছে। এটা ধনী-গরিব বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
মহামারির কারণে ৩০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মানব উন্নয়ন বিশ্বব্যাপী হ্রাস পেয়েছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো চরম দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ৯ কোটি লোককে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে এই মহামারি। ৩২ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নামিয়ে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, যাদের প্রতিদিনের আয় ১ দশমিক ৯০ ডলারের (বর্তমানে প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ২০ পয়সা হিসাবে ১৬৩ টাকা ৭৮ পয়সা) কম তাদেরকে চরম দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আর যাদের দিনে উপার্জন ৩ দশমিক ২০ থেকে ৫ দশমিক ৫০ ডলার তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে বলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা মহামারির ছোবলে উন্নয়নশীল এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১০ কোটি ৯০ লাখ থেকে বেড়ে ১৬ কোটি ৭০ লাখ হয়েছে, যা বিশ্বের মোট বেকারের ৭০ শতাংশ। মজুরি আয়ের ক্ষতি হয়েছে ৩৪৮ বিলিয়ন থেকে ৫৩৩ বিলিয়ন ডলার।
করোনা মহামারির ধাক্কায় চলতি বছরে সারা বিশ্বে বেকার লোকের সংখ্যা বাড়বে। ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে ১৮ কোটি ৬০ লাখ বেকার ছিল। এ বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ২০ কোটি ৭০ লাখে। করোনার ধাক্কায় দুই বছরের ব্যবধানে সারা বিশ্বে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ বেকার বাড়বে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০২২ সালের ‘ওয়ার্ল্ড এমপয়মেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল আউটলুক’ প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সোমবার এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।
আইএলওর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় ৪ কোটি ৪০ লাখ লোক বেকার থেকে যাবে। এর মানে, সারা বিশ্বের বেকারদের মধ্যে প্রতি চারজনে একজন হবে দক্ষিণ এশীয়। যথেষ্ট দক্ষতা সত্ত্বেও মনমতো কাজ পাচ্ছেন না দক্ষিণ এশিয়ার ৭ কোটি ৮৯ লাখ তরুণ-তরুণী। তারা জীবিকার তাগিদে অপেক্ষাকৃত কম মজুরির কাজ করেন।
আইএলওর প্রতিবেদনে বিশ্বের কোন অঞ্চলে এ বছর বেকার কত থাকবে, তার বিবরণও দেওয়া হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বেকার থাকবে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে। এই অঞ্চলে ৯ কোটি ৫০ লাখ বেকার থেকে যাবে। এই হিসাবের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বেকাররাও রয়েছে। এরপর আফ্রিকায় ৪ কোটি ৪১ লাখ বেকার থাকবেন। এছাড়া লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ২ কোটি ৬৪ লাখ, ইউরোপে ২ কোটি ২০ লাখ, উত্তর আমেরিকায় ৭৬ লাখ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৪৮ লাখ, কেন্দ্রীয় ও পশ্চিম এশিয়ায় ৭৩ লাখ বেকার থাকবেন।
আইএলওর প্রতিবেদনে দেশভিত্তিক শ্রমশক্তি, কর্মজীবী ও বেকারের হিসাব দেওয়া হয়নি। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৬-১৭) অনুযায়ী, সারা দেশে তখন ২৬ লাখ ৭৭ হাজার বেকার লোক ছিল।
এদিকে, করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের নিম্নবিত্তের আয় ৭৫ ভাগ কমেছে, চরম দারিদ্র্যের হার বেড়েছে৷ বাংলাদেশের এনজিও ব্র্যাকের এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে৷
নিম্নআয়ের মানুষের উপর করোনা ভাইরাসের প্রভাব কতটা পড়েছে তা জানতে দুই হাজার ৬৭৫ জনের উপর একটি জরিপ চালিয়েছে ব্র্যাক৷ করোনার প্রকোপ শুরুর আগে জরিপে অংশ নেয়াদের গড় পারিবারিক আয় ছিল ১৪ হাজার ৫৯৯ টাকা৷ মার্চে তা নেমে এসেছে তিন হাজার ৭৪২ টাকায়৷ অর্থাৎ, তাদের গড় আয় ৭৫ ভাগ কমে গেছে৷
আয়ের ভিত্তিতে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৯ ভাগই চরম বা হতদরিদ্র্যের স্তরে নেমে গেছেন৷ এ কারণে আগের তুলনায় চরম দারিদ্র্যের সংখ্যা ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে৷
এডিবির প্রতিবেদনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম চালাতে দেশগুলোকে আহ্বান জানানো হয়েছে। সে ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তি, ক্ষমতায়ন এবং পরিবেশগত টেকসইয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (ইসক্যাপ), এডিবি এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) যৌথভাবে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
এতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য মহামারির প্রভাব বা ধাক্কা এবং ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপের বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় রাখতে দেশগুলোর সরকার প্রধানদের অনুরোধ করা হয়েছে। এই অঞ্চলের পুনরুদ্ধারের গতিশীলতা যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভর করছে কোভিড-১৯ টিকা, ডায়াগনস্টিকস ও থেরাপিউটিকস এবং সেসঙ্গে সামাজিক সুরক্ষা কভারেজ সিস্টেমের পর্যাপ্ততার ওপর।
প্রদিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এডিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট শিক্সিন চেন বলেন, ‘মহামারি আঘাত হানার আগে এসডিজি বাস্তবায়নে দেশগুলো ভালোই অগ্রসর হচ্ছিল। এখন সেটা ব্যাহত হচ্ছে। আর্থিক চাপ এবং ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ নতুন চ্যালেঞ্জে হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই এসডিজি বাস্তবায়নে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুতি পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।
‘এই অঞ্চলের দেশগুলোর সরকার প্রধানদের ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়নের এজেন্ডাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় নিশ্চিত করে জাতীয় পুনরুদ্ধারের কৌশলগুলো পর্যালোচনা ও সংশোধন করতে হবে। নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং অসহায় গরীব জনগোষ্ঠীর চাহিদার দিকে বেশি জোর দিতে হবে।’
এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঞ্চল। এই অঞ্চলে ৫৩টি দেশ অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, জাপান, জর্ডান, কুয়েত, মালদ্বীপ, সৌদি আরব ও সিঙ্গাপুর রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১০
আপনার মতামত জানানঃ