নানা সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলনে সীমান্তে নন-লিথ্যাল উইপন (প্রাণঘাতী নয়) অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে সদিচ্ছার কথাও বলেন নীতিনির্ধারকরা। এমনকি উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ের আলোচনায়ও সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত; কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই চোখে পড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।
সম্প্রতি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে লিটন আলী (৩৫) নামে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়েছেন। সে উপজেলার প্রাগপুর ইউনিয়নের বিলগাথুয়া গ্রামের আকবর আলী বিশ্বাসের ছেলে।
নিরপরাধ যুবক নিহত
নিহতের স্বজন ও স্থানীয়রা জানান, শনিবার রাত লিটন বিগগাথুয়া সীমান্তের ১৫১/৬ এক্স পিলারের কাছে মাঠে যায়। অসাবধানতাবশত সে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করলে ভারতের হোগলবাড়িয়া থানার মেঘনা ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
এ সময় লিটন গুলিবিদ্ধ হলে বিএসএফ সদস্যরা গুলিবিদ্ধ লিটনকে নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে গুলিবিদ্ধ লিটন মারা গেছে বলে আজ রোববার সকালে জানা যায়।
লিটনের চাচাতো ভাই সাবেক ইউপি সদস্য মো. ইসলাম জানান, লিটন কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। কোনো কারণে হয়ত সে মাঠে গিয়েছিল।
স্থানীয় প্রাগপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম মুকুল জানান, লিটন বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তার লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য যোগাযোগ করা হচ্ছে।
বিজিবি প্রাগপুর কোম্পানি কমান্ডার নায়েক সুবেদার আমজাদ আলী বলেন, স্থানীয়দের কাছ থেকে লিটনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। বিএসএফ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সীমান্তে লাশের মিছিল
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো এসব নিহত বাংলাদেশি নাগরিককে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত এবং চোরাচালানকারী বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
সীমান্তে কোনো নাগরিককে হত্যার অধিকার কারও নেই। এটা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামাতে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে। মানবাধিকার সংস্থার মতে, ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দুই দশকে এক হাজার ২৩৬ জনের বেশি বাংলাদেশিকে সীমান্তে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী! এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যা করা হয়েছে ২০০৯ সালে, ৬৬ জন। এমনকি ২০২০ সালে করোনা মহামারীর মধ্যেও হত্যা করা হয়েছে ৫১ বাংলাদেশিকে।
২০২১ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএসফের গুলিতে ১৮ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এর আগে ২০২০ সালে মোট ৪৮ জন নিহত হয়েছেন। গুলিতে ৪২ জন এবং নির্যাতন চালিয়ে ছয় জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ। অপহরণ করা হয়েছে ২২ জনকে। আহত হয়েছেন ২৬ জন।
২০১৯ সালে বিএসএফ-এর হাতে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন। এরমধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয়জন। অপহরণ করা হয়েছে ৩৪ জনকে। আহত হয়েছেন ৪৮ জন।
২০১৮ সালে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো ছিলো। তারপরও ওই বছর বিএসএফ সীমান্তে মোট ১৪ বাংলাদেশিকে হত্যা করে। এরমধ্যে গুলি করে আটজনকে হত্যা করা হয়। অপহরণ করা হয় ১৩ জনকে এবং আহত হন ১৫ জন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
আসকের সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বার বার সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা বন্ধ হচ্ছেনা। তারা সীমান্ত হত্যা শূণ্যে নামিয়ে আনার কথা বলার পরই আবার সীমান্ত হত্যা শুরু হয়। তাদের আচরণ দেখে মনে হয় ভারত নিজেদের প্রভু মনে করে। আর আমরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারব না।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের সাথেও ভারতের সীমান্ত আছে। সীমান্ত সমস্যা আছে। কিন্তু সেখানে কিন্তু ভারত এভাবে গুলি চালায় না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শুধু গরু চোরাচালান হয় না, ভারত থেকে ফেনসিডিল, মাদক এবং অবৈধ অস্ত্রও আসে। সেটা বিএসএফ দেখে না। আর গরু তো শুধু পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসে না। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসে। সেখানে কেন আটকানো হয় না?
ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ ( মাসুম) মনে করে বিএএসফ সদস্যরা যখন ঠিকমত ভাগ না পায় তখন গুলি করে। সংগঠনটির প্রধান কিরিটী রায় দাবী করেন, একদানা চিনিও বিএসএফ-এর নজর এড়িয়ে যেতে পারে না বাংলাদেশে। এরা দুর্নীতিগ্রস্ত। এদের কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত। এর প্রমাণ বার বার পাওয়া গেছে। চোরাচালান ঠেকানোর নামে তখনই তারা গুলি করে যখন তাদের ভাগ বাটোয়ারায় কম পড়ে।
তিনি বলেন, বিএসএফ শুধু বাংলাদেশিদের নয় ভারতের বাঙালিদেরও হত্যা করছে। কেন্দ্রীয় সরকার বিএসএফ-এর হাতে অনেক ক্ষমতা দিতে চায়। তারা বাংলাদেশকে বন্ধু রাষ্ট্র বলে জানালেও বাস্তবে সেটা তারা মনে করে না। আর বাংলাদেশ সরকার চুপ করে আছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের এই দুই মানবাধিকার কর্মী মনে করেন, ভারতের মুখের কথা আসলে বাস্তবে দেখা যায় না। তাই বাংলাদেশের উচিত সীমান্ত হত্যা বন্ধে আরো শক্ত অবস্থানে যাওয়া।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩৫
আপনার মতামত জানানঃ