যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ায় বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলকে নতুন কৌশলগত জোট খুঁজে বের করতে উৎসাহিত করেছে। এমন দৃষ্টান্তের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সম্প্রতি তুরস্ক ও ইসরাইলের মধ্যে একটি পরিবর্তন আসা। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশ দুটির মধ্যে গভীর দ্বন্দ্ব চলছে।
কিন্তু সম্প্রতি দুই দেশই পরস্পরের প্রতি সুর নরম করেছে। পারস্পরিক স্বার্থে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ ছিল বলে জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হেরজোগের সঙ্গে বিরল ফোনালাপের পর এ কথা জানান এরদোয়ান।
তুরস্কের যোগাযোগ অধিদপ্তরের বরাতে আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের বিকল্প নেই। দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক সংকট সমাধানে সমঝোতার উদ্দেশ্যে আলোচনা হলে মতবিরোধ কমানো সম্ভব বলেও মনে করে আঙ্কারা।
আঞ্চলিক শান্তি, সহিষ্ণুতা ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এরদোয়ান জোর দিয়েছেন ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সম্পর্কোন্নয়ন এবং শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর ওপর।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন, তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হলে তা ‘দুই পক্ষের জন্য সমান লাভজনক’ হতে হবে।
ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতেও আলোচনা ইতিবাচক উল্লেখ করা হয়েছে। দুই নেতার যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছে তেল আবিব।
দুই নেতার ফোনালাপের আগে তুরস্কে গুপ্তচর সন্দেহে আটক এক দম্পতিকে মুক্তি দেয়া হয়। তাদের মুক্তির প্রতিক্রিয়ায় এরদোয়ানের সঙ্গে তখন ফোনে কথা বলেছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটও।
২০১৩ সালের পর এটি ছিল তুরস্ক ও ইসরায়েলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে প্রথম কথোপকথন।
ফিলিস্তিনের সরব সমর্থক তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েল সন্ত্রাসী আচরণ চাপিয়ে দিচ্ছে বলে প্রায়ই অভিযোগ করেন তিনি।
এ নিয়ে তুরস্ক ও ইসরায়েলের সম্পর্ক বরাবরই তিক্ত ছিল। বিশেষ করে ২০১৮ সালে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের হত্যার পর দুই দেশই তাদের রাষ্ট্রদূত ফিরিয়ে নেয়।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কই ইসরায়েলকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। ১৯৪৯ সালে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া তুরস্ক দীর্ঘ ছয় দশক দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে। এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের উষ্ণ ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এরপর কেন এই বৈরিতা। ফিলিস্তিনের প্রতি ইসরায়েলের অমানবিক নীতিই কি এর একমাত্র কারণ। নাকি অন্য কিছু!
দেশ দুটির ৬০ বছরের সুসম্পর্কে তিক্ততা শুরু হয় বছর দশেক আগে। নথি ঘেঁটে দেখায় যায়, তুরস্কের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক ছিন্ন হবার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ২০১০ সালে গাজা অভিমুখে তুরস্কের ত্রানবাহি ‘মাভি মারমারা’ জাহাজে ইসরায়েলি সৈন্যদের হামলা। এই হামলায় তুরস্কের ১০ জন নাগরিক নিহত হবার পর দু’দেশ সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করে। এই হামলার পর ইসরাইলের সাথে তুরস্কের কূটনীতিক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এরপর ২০১৬ সালে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়। দু’দেশ একটি চুক্তিতে আসে। এই চুক্তিতে ইসরায়েল তুরস্ককে ২০ মিলিয়ন ডালার ক্ষতিপূরণ দেয়। এছাড়া তুরস্ক যাতে গাজায় সাহায্য পাঠাতে পারে এবং ফিলিস্তিনের ভেতরে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করতে পারে ইসরায়েল সে অনুমতিও দেয়। সে সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছিলেন, এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
এর আগে ২০০২ সালে এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে দেশ দুটি বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা ও পর্যটন খাতে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিল। ক্ষমতায় আসার পর এরদোয়ান ২০০৫ সালে ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব অবসানে শান্তির বার্তা নিয়ে ইসরায়েল সফর করেছিলেন। ২০০৮-০৯ সালে গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণকে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ হিসেবে অভিহিতও করেন।
এরপর ২০১৮ সালে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এবং এর প্রতিবাদে আন্দোলনরত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েল হামলা চালালে প্রতিবাদ হিসেবে ইসরায়েল থেকে রাষ্ট্রদূত সরিয়ে নেয় তুরস্ক।
শুধু নেতানিয়াহুকে গদি থেকে সরানোর জন্য ইসরায়েলের পরস্পরবিরোধী মতের আটটি দল জোট করে সরকার গঠন করেছে। তার মানে এই নয় যে নেতানিয়াহুর পররাষ্ট্রনীতিকে তারা পুরোপুরি উল্টেপাল্টে দেবে। তবে তার কিছু কাজকে অবশ্যই বিভিন্ন শরিক দল বাতিল করতে চাইবে।
আর এই কাজগুলো দক্ষতার সাথে করতে ইসরায়েলের নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের সরকার এখন দেশটির পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ করছে। নেতানিয়াহুর রেখে যাওয়া পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করে তারা নতুন একটি কর্মকৌশল তৈরি করতে চাইছে। আর এই কর্মকৌশলের দাবার বোর্ডে তুরস্ক যেন বিপক্ষ দলের মন্ত্রী। বাগে আনতে তাই বেনেটকে ছক কষতে হবে সুকৌশলে।
আর এরই মধ্যে বিশ্ব রাজনীতিতে ইসরায়েলের নতুন সরকার তুরস্কের সঙ্গে তাদের সাবেক সুসম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে পারবে কি না, এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে।
গত ডিসেম্বরে এরদোয়ান বলেন, আমরা নিজেদের সম্পর্ক একটা ভালো অবস্থায় নিয়ে আসতে চাই। গোয়েন্দা পর্যায়ে দুদেশের মধ্যে সহযোগিতা চলছে।
ফেব্রুয়ারিতে আঙ্কারায় দূতাবাসে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে ইরিত লিলিয়ানকে নিয়োগ দিয়েছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলি খবরের অনলাইন ১২৪নিউজ বলছে, তুরস্ক বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইরিত লিলিয়ানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যা এরদোয়ানকে ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি বার্তা।
ওয়েবসাইটটি জানায়, এমন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ আঙ্কারার সঙ্গে পুরনো উষ্ণ সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে তেলআবিবের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন।
এসব ঘটনা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, ইসরায়েল ও তুরস্কের মধ্যে বর্তমানে কোনো স্বার্থের সংঘাত নেই। আর সংকটের এসব উৎসও সাময়িক ও তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনার প্রতিফলন।
এছাড়া পূর্ব ভূমধ্যসাগরের গ্যাস মজুদ নিয়েও দু-দেশের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেই আভাসও দিয়েছিলেন। কাজেই সবার ভাবনার চেয়েও দ্রুত সময়ে তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩২
আপনার মতামত জানানঃ