দীঘির টলটলে পানিতে নিশানা করে অর্জুনের মাছের চোখ বিদ্ধ করার মহাভারত আজকের বাংলাদেশ। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে হাঁসফাঁস মানুষের জীবন। মধ্যবিত্তদের গলা টিপে ধরে আছে চাল ডাল তেলের দাম। এর পাশাপাশি বাক স্বাধীনতার বুকে ছুরি চালিয়ে ক্ষমতাসীন দলের স্বাধীনতা বিরোধী এক অস্তিত্বহীন শক্তির প্রপাগন্ডা একনায়কতন্ত্রের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগকে।
বিবিধ সমস্যায় জর্জরিত মানুষের ফোকাস সরিয়ে নিতে সরকার এর আগেও বিভিন্ন ঘটনা দুর্ঘটনার এন্তেজাম করেছেন। তাই বিশেষজ্ঞ এক মহলের ধারণা, কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতি দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি থেকে মানুষের ফোকাস সরিয়ে নেয়া। এবং তা অনেকটা সফলও। নতুন ইস্যুর চাপে প্রয়োজনীয় ইস্যু হারিয়ে যাওয়া নতুন কিছু নয়।
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাস মহামারি আসার পর পুরো বিশ্বেই স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে, তবে এই হার যেন আকাশচুম্বী রাজধানী ঢাকায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম একমাসে প্রায় ১৯.৬৪% বেড়ে গেছে, একমাসের ভেতর দ্রব্যমূল্যের দাম এতোটা বাড়তে আগে কখনওই দেখা যায়নি বলে দাবি সংস্থাটির। বাজারে এক কেজি চালের দাম ৬০ টাকা। এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৫০ টাকা। কিছুদিন আগেও এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ১২০ টাকায় কেনা যেত, এখন সেটা ১৭৫ টাকা।
প্রতি কেজি চিনিতে এখন ২৮ টাকা ও ভোজ্যতেলে ২০ টাকার মতো কর পড়ছে। যেহেতু পণ্যের দামে কর শতাংশ হারে আদায় হয়, সেহেতু বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে করের পরিমাণও বেড়ে যায়। এদিকে ব্যবসায়ী সূত্র জানায়, সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১১ টাকা বাড়িয়ে ১৬৪ টাকা এবং চিনির দাম কেজিতে ৯ টাকা বাড়িয়ে ৮৪ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব সরকারের কাছে দেওয়া আছে। তবে তা প্রস্তাব অব্দিই।
এর মধ্যে করোনাকালে দারিদ্র্য পরিস্থিতি কী দাঁড়াল, তা নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কোনো জরিপ নেই। বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলেছিল, দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে (৪২ শতাংশ)। যদিও সরকার তা মেনে নেয়নি। নিজেরাও কোনো জরিপ করেনি। বিবিএস গত বছরের অক্টোবরে এক টেলিফোন জরিপে জানিয়েছিল, মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশের মতো।
সরকার ব্যর্থতা ঢাকতে আশ্রয় নিচ্ছে তাদের পুরনো এবং সফল কৌশলের কাছেই। অতিষ্ঠ মানুষের কাছে তুলে ধরছে আলোচনা সমালোচনা আর বিভাজনের জন্য সুযোগ্য এক সমস্যা। আর তা হলো ধর্ম। সাম্প্রদায়িকতা। সুপ্রাচীন কাল থেকে এই উপমহাদেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সদ্ভাব নিয়ে বসবাস করে আসছে। ধর্ম সমস্যার কারণ নয়। সমস্যা তৈরর মাধ্যম হয়ে উঠেছে এখানে। আর এর কলকাঠি আছে ক্ষমতাসীন দলের মাস্টারমাইন্ডের হাতে। পলিটিক্যালি করাপ্টেড এই দলের কারণে সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশ বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখোমুখি হয়েছে। অত্যাচারিত হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। উজাড় হয়েছে ঘরবাড়ি। এজন্য খুব অতীতে যেতে হবে না। সুনামগঞ্জের শাল্লা, ঝুমন দাস খুলনার রূপসা সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘুদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার প্রকৃত সত্য সামনে নিয়ে এসেছে।
এবার দুর্গাপূজার সময়েই কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার খবর উস্কে দিচ্ছে চিরাচরিত দৃশ্যকে। এর পাশাপাশি এই ঘটনার জেরে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে হামলার ঘটনায় গতকাল বুধবার রাত ১১টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পরিস্থিত ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এ ঘটনা তদন্তে আজ বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। চাঁদপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছি। সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দুই প্লাটুন বিজিবি ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে।’
স্থানীয় সূত্র মতে, গতকাল রাত সোয়া ৮টায় হাজীগঞ্জ পৌর এলাকায় ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে মিছিল বের করা হয়। ওই মিছিল থেকে লক্ষ্মীনারায়ণ আখড়ায় ঢিল ছোড়া হয়। একপর্যায়ে মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পুলিশ গুলি চালায়। এতে তিনজন নিহত ও পুলিশসহ অন্তত ৫০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের সিভিল সার্জন মো.সাখাওয়াত উল্যাহ বলেন, নিহত তিন ব্যক্তির লাশ আজ সকালে হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ময়নাতদন্তের জন্য চাঁদপুর সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননাসংক্রান্ত খবরটি খতিয়ে দেখছে সরকার। গতকাল এক তথ্য বিবরণীতে সরকারের পক্ষ থেকে এ কথা জানানো হয়েছে।
তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননাসংক্রান্ত খবরটি সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ঘটনা খতিয়ে দেখার জন্য ইতিমধ্যে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে যদি কেউ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে, তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইন হাতে তুলে না নেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের কুমিল্লা শহরের নানুয়ারদীঘি এলাকার একটি পূজামণ্ডপের প্রতিমায় কোরআন রাখার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ওই পূজামণ্ডপ থেকে কোরআন উদ্ধারের পর বেশ কয়েকটি পূজামণ্ডপে হামলাও হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার পূজা উদযাপন কমিটির সম্পাদক নির্মল পাল।
প্রসঙ্গত, যখন বাঙ্গালী হিন্দু সম্প্রদায় এখন তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করছে, তখনই কোরআন অবমাননার অভিযোগে এই ঘটনা ঘটলো।
বিবিসির সূত্র মতে, এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ গিয়ে তা উদ্ধার করে এবং এরপর পরই একদল ব্যক্তি বেশ কিছু পূজামণ্ডপে হামলার চেষ্টা চালায়।
নির্মল পাল বলেন, “পূজা বানচালের জন্য পরিকল্পিতভাবে কোরআন রেখে এ ঘটনা ঘটিয়ে তারাই এখন শহরজুড়ে পূজাবিরোধী বিক্ষোভ করছে। কয়েকটি মণ্ডপে হামলার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু পুলিশের বাধায় ভেতরে ঢুকতে না পারলেও গেইট বা সামনের স্থাপনা ভাংচুর করেছে।”
এদিকে, জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ জানান, আমরা পেট্রল দিচ্ছি। আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করি। কয়টি মণ্ডপে হামলার চেষ্টা হয়েছে এ মূহুর্তে বলতে পারছি না। পরিস্থিতি ঠিক হলে আমরা বিস্তারিত জানাবো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, বেলা এগারটার দিকে হঠাৎ কোরআন অবমাননা হয়েছে, এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে শহর জুড়ে। দশটার পর নানুয়ারদীঘির মণ্ডপে কোরআন নজরে পড়লে দ্রুত পুলিশকে জানানো হয় এবং পুলিশ তখনি এসে কোরআনটি সরিয়ে নেয়।
তিনি আরও বলেন, কিন্তু খবরটি খুব দ্রুত ছড়ানো হয় এবং কয়েকটি মাদ্রাসার লোকজন ছাড়াও স্থানীয় অনেকে প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে সেখান থেকে মণ্ডপ গুলোতে হামলা করা শুরু হলে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়।
তিনি বলেন, কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা গেলেও সেগুলো কোথায় হয়েছে তা বোঝা যায়নি। এদিকে ঘটনার পরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোরআন অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে ব্যাপক প্রচার শুরু হয় এবং অনেকে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অনেকে ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ