বেড়েছে তাপমাত্রা। পরিবর্তন ঘটছে প্রাকৃতিক পরিবেশের। বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে আবহাওয়ার ভয়াবহ বৈরিতা। গত ১০০ বছরে পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, গত দশ বছরে বিশ্বে যত বন্যা, ঝড় ও দাবানল হয়েছে তার সবই এই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণেই হয়েছে। বৃক্ষনিধন, শিল্প-কারখানা স্থাপন, দূষণ ও নগরায়নের ফলে আবহাওয়ায় এই দীর্ঘস্থায়ী বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জনবসতির ওপর প্রতিনিয়ত নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ইত্যাদি আঘাত হেনেছে।
এদিকে ফাইন্যান্স ফর বায়োডাইভারসিটি ইনিশিয়েটিভ (এফ ফর বি) কর্তৃক প্রকাশিত এক গবেষণা জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রায়ত্ত উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর করা বিনিয়োগ থেকে প্রতি বছর ৮০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের (প্রায় ৬৮ লাখ কোটি টাকা) প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে থাকে। রাষ্ট্রায়ত্ত উন্নয়ন ব্যাংকগুলো কীভাবে তাদের বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রকৃতিকে প্রভাবিত করছে সে ব্যাপারে বিস্তারিত বিশ্লেষণ উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট গবেষকরা এ তথ্য জানানোর পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের ঝুঁকি কমাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রকল্পে আরও স্বচ্ছতা আনার আহ্বান জানিয়েছেন। রয়টার্সের খবর
গবেষকরা অনুমান করছেন, ব্যাংকের অর্থায়ন থেকে সম্ভাব্য প্রাকৃতিক ক্ষতির জন্য ভবিষ্যতে আমাদের বার্ষিক ৮০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হতে পারে।
এফ ফর বি’র চেয়ারম্যান সাইমন জাদেক বলেন, এ গবেষণায় প্রকৃতি-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো পরিমাপ করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক সমর্থিত কার্যকলাপ থেকে প্রাকৃতিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা, অথবা উদ্ভিদ, প্রাণী এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর ব্যাংকগুলোর নির্ভরতা কীভাবে তাদের বিনিয়োগের মূল্যমান হ্রাস করতে পারে তা তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাংকগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ প্রকৃতি-সংবেদনশীল খাতগুলোয় যাচ্ছে; বিশেষ করে খাদ্য, খনি এবং অবকাঠামো খাত, যেগুলো প্রায়শই জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ পরিবেশকে ব্যাহত করে গড়ে উঠে সেগুলোয় যাচ্ছে।
জাদেক রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেন, অবকাঠামো নির্মাণ, খনন বা কৃষি খাত বিস্তারের ফলে আশেপাশের জলাভূমি বা বন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এবং স্থানীয় পানি সরবরাহ দূষিত হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ব্রাজিলের একটি প্রধান মাংস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা লাইবেরিয়ার একটি পাম অয়েল কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত্ত উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর সহায়তায় অবৈধভাবে বন উজাড় করে জমি দখল করতে পারে।
গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, কিছু পাবলিক ব্যাংক প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। তবে বিশ্বব্যাপী ৪৫০টিরও বেশি এরকম ব্যাংকের কাছে থাকা ১১.৬ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদের ৪০ শতাংশই পানি, মাটি এবং পরাগায়নের মতো ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভর করে।
উন্নয়ন ব্যাংকগুলো একরকম পরিবেশগত সুরক্ষা নীতি অনুসরণ করে থাকলেও এই গবেষণা বলছে, সেসব নীতি পর্যাপ্ত না।
গবেষণা প্রবন্ধে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে আগামী ১২ মাসের মধ্যে তাদের সমস্ত বিনিয়োগ পোর্টফোলিও প্রকৃতির উপর কেমন চাপ ফেলছে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রকাশ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ব্যাংকগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ প্রকৃতি-সংবেদনশীল খাতগুলোয় যাচ্ছে; বিশেষ করে খাদ্য, খনি এবং অবকাঠামো খাত, যেগুলো প্রায়শই জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ পরিবেশকে ব্যাহত করে গড়ে উঠে সেগুলোয় যাচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সরকারের মালিকানাধীন এবং তাদের সম্মিলিত সম্পদ বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগের প্রায় ১০ শতাংশ।
এদের মধ্যে রয়েছে বিশ্বব্যাংক, ইন্টার-আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।
এফ ফর বি’র প্রতিনিধি জেরেমি এপ্পেল এক বিবৃতিতে বলেন, “জনসাধারণের মালিকানাধীন এই ব্যাংকগুলোর পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করায় তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করা উচিত। এখন এই জি-সেভেন সরকারগুলোর উচিত তাদের প্রভাব এবং ক্ষমতা ব্যবহার করে এই উন্নয়ন ব্যাংকগুলো তাদের কর্মকাণ্ডে প্রকৃতির কথা বিবেচনা করছে কি না তা নিশ্চিত করা।”
‘কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাড়ার কারণেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে’- সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস প্রথম এই মন্তব্য করেছিলেন সেই ১৮৯৮ সালে। তারপর বিশ্ব বায়ুমণ্ডল নিয়ে গত শতাব্দীর সত্তর দশকে কোনো বিজ্ঞানী আর ততোটা মাথা ঘামাননি। তবে শতাব্দীর শেষ ভাগে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞানীদের টনক নড়ে। রিওডি জেনেরিওর সম্মেলনের পর নীতি প্রণেতারা আবহাওয়ার বৈরিতা নিয়ে সজাগ হন। আবহাওয়ার পরিবর্তন সম্পর্কে জনসাধারণকে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) এবং বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহ এবং সম্ভাব্য প্রতিবিধানের দিক নির্দেশনা প্রদানের উদ্দেশ্যে গঠন করেছে আন্তঃমহাদেশীয় প্যানেল— আইপিসিসিআই।
আবহাওয়া পরিবর্তনের পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে সম্প্রতি যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তা হলো: ‘মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যাই পৃথিবীর উষ্ণতার জন্য দায়ী। গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়া, ওজন স্তর ক্ষয় এসবই মানুষের কারণে সৃষ্ট। এসব কারণেই আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে।’ মানুষ নির্গমন করছে ক্ষতিকর গ্যাস, যেমন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, সিএফসি বা ক্লোরোফ্লোরো কার্বনসহ মিথাইল ক্লোরোফর্ম ইত্যাদি। এছাড়া জীবাশ্মকে জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়ে তাতে উৎপাদন করা হচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এই বাড়তি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে গাছ। কিন্তু বন কেটে ফেলার কারণে বিরূপ প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিশিল্পে আধুনিকায়নের ফলে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড বেশি পরিমাণে নির্গত হচ্ছে। এর ফলে বায়ুমণ্ডল তাপ আটকে রাখছে।
এভাবে বায়ুমণ্ডলের যত দ্রুত পরিবর্তন ঘটবে, ক্ষতিও বাড়বে ততো দ্রুত। বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সাগর পৃষ্টের উচ্চতা ১৫ থেকে ৯৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়বে। দেখা দেবে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আবহাওয়া হয়ে উঠবে আরও শুষ্ক, আরও উত্তপ্ত কিংবা কঠিন বরফশীতল। ফলে বিলুপ্ত হবে বিশেষ প্রজাতির জীব। মানবসমাজও নতুন নতুন রোগ, ঝুঁকি ও দুর্যোগের সন্মুখীন হবে। অবশ্য বর্তমান বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকি কবলিত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও কোনো কোনো অঞ্চল খাদ্য ঘাটতির শিকার হতে পারে।
বাষ্পীভবনের ধরন পরিবর্তনের ফলে জলজ সস্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে সাগরের উঞ্চতা বাড়ার কারণে ভৌত অবকাঠামো বিনষ্ট হবে। আবহাওয়া পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। বিগত শতাব্দীর শেষ দশকের উপাত্ত থেকে অনুমান করা যাচ্ছে, চলতি দশকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন বাড়বে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো পরিবেশ সংকটের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চোখের নিমেষে এখন মানুষ পরিবেশ ও প্রকৃতিকে পরিবর্তন করছে। জোর করে, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে, অবৈধ ও অন্যায়ভাবে, এমনকি আইনের প্রশ্রয়েও হচ্ছে অনেক কিছুই। বনভূমি উজাড় করে তৈরি হয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি ও শিল্প-কারখানা, শুরু হচ্ছে চাষাবাদ। ফসলি ও আবাদি জমি পাল্টে হচ্ছে ইটভাটা, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে নদী ভরাট হয়ে সেখানে তৈরি হচ্ছে সড়ক, সরকারি পুকুর ভরাট করে রাতারাতি তৈরি হচ্ছে বসতভিটা কিংবা দোকান, চলছে প্লট বরাদ্দের বাণিজ্য, বিদ্যালয়ের মাঠে হঠাৎ পুকুর তৈরি করে হচ্ছে মাছ চাষ।
জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে হচ্ছে সড়ক—প্রতিনিয়ত মারা পড়ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী, অবিরাম পাহাড় কেটে তৈরি করা হচ্ছে রাস্তা এবং বিনোদনের ক্ষেত্রসহ আরো কত কিছু, টিলা কেটে তৈরি করা হচ্ছে কলাবাগান ও হাউজিং কমপ্লেক্স। এ রকম অনেক উদাহরণ তুলে ধরা সম্ভব। নির্ভরযোগ্য মিডিয়ার সাহসী ভূমিকায় ও কল্যাণে এসব খবর নিশ্চয়ই আমাদের অজানা নয়। চোখের সামনেই এসব পরিবর্তন আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, যা অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রয়োজনীয়, অশোভনীয়, বেআইনি এবং চরম নিন্দনীয় কাজ। একই সঙ্গে তা অনেক কারণের পাশাপাশি কভিড-১৯-এর মতো রোগ সৃষ্টির পেছনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তারা বলেন, পরিবেশ ও প্রকৃতি কথা বলতে পারছে না, দুর্বলের ওপর সবলের অর্থাৎ মানুষের আঘাত তাই ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ফলে এটা সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার যে মানুষ চাইলেই এখন নিজের প্রয়োজনে ও স্বার্থে প্রকৃতি ও পরিবেশের আচরণে বড় বড় পরিবর্তন ঘটিয়ে দিচ্ছে। সমস্যা হলো এ আচরণ পরিবর্তনের ফলটা যদি মানুষ তাত্ক্ষণিকভাবে দেখতে পেত বা দেখানোর কোনো ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা থাকত তাহলে মানুষ হয়তো এসব আচরণ পরিবর্তন থেকে নিজেদের অনেকটাই নিবৃত ও নিয়ন্ত্রিত করত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২৭
আপনার মতামত জানানঃ