দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিনে মুক্তি পেয়েই তৎপরতা শুরু করেছেন। কেউ প্রকাশ্য, কেউ আড়ালে আবার কেউ বা বিদেশে বসে ঢাকার অপরাধ জগতের কলকাঠি নাড়ছেন। ইতিমধ্যে তারা তাদের অবস্থান জানান দিয়েছেন বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্যদিয়ে। পেশি শক্তির প্রদর্শন থেকে শুরু করে দলবল নিয়ে মহড়া, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, হামলা, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রের কেনাবেচা, জমি দখল ও খুন-খারাবিতে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়াদের মধ্যে অন্যতম ৬ শীর্ষ সন্ত্রাসী রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- ইমন, পিচ্চি হেলাল, কিলার আব্বাস, সুইডেন আসলাম, টিটন ও ফ্রিডম রাসু। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর থেকে তারা এলাকা নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার, পেশি শক্তির প্রদর্শন, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণসহ একের পর এক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা জিডি হয়েছে।
ঢাকার অপরাধ জগতের খোঁজ-খবর রাখেন এমন সূত্র বলছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই মতিঝিল, মগবাজার, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় প্রকাশ্যে আধিপত্য বিস্তার শুরু করেছেন। টেন্ডার, পরিবহন, ডিশ, ইন্টারনেট, ফুটপাথ, বাজার, ঝুট ব্যবসা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও নির্মাণকাজ থেকে এবং জমি দখলের মতো খাত থেকে চাঁদাবাজি করছেন। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গত বছরের ১৫ আগস্ট দুপুরে মুক্তি পান সরকার কর্তৃক পুরস্কার ঘোষিত ২৩ সন্ত্রাসীর অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন। পরেরদিন ১৬ই আগস্ট রাতে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার-৪ থেকে জামিনে মুক্তি পান পিচ্চি হেলাল। কারামুক্তির পর এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী এখন আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে লিপ্ত। সম্প্রতি ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে দুই ব্যবসায়ীর ওপর হামলার নেপথ্যে এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর ব্যক্তিগত আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজির দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে এসেছে। ইমন ও পিচ্চি হেলাল দু’জনই জেলে থাকা অবস্থায় তারা তাদের নিজ নিজ এলাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। জামিনে মুক্তি পেয়ে তারা পুরোপুরি বেপরোয়া। অপরাধের পুরনো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মহড়া দেয়ার পাশাপাশি চাঁদা চেয়ে ব্যবসায়ীদের হুমকি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
গত বছর ২০শে সেপ্টেম্বর রায়েরবাজারে সাদেক খান আড়তের সামনে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। ওই দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ২২শে সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এলাকার দখল নিতে সন্ত্রাসীদের দুইপক্ষের বিরোধ থেকে জোড়া খুনের ওই ঘটনা। তবে ওই ঘটনার পর চার মাস পরেও পিচ্চি হেলালকে গ্রেপ্তার করেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুরসহ আশেপাশের এলাকায় নানা অভিযোগ রয়েছে।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্যতম ইমনও বেপরোয়া। জামিনে মুক্তি পেয়ে ইমন ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকায় গড়ে তুলেছেন চাঁদাবাজির বলয়। তার বিরুদ্ধে দক্ষিণের প্রায় সব এলাকার টেন্ডার, ময়লা অপসারণ, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ-সংস্কার, বাণিজ্য, ডিশ-ইন্টারনেট ব্যবসা, পরিবহন, ফুটপাথ, বাজার, ঝুট ব্যবসা, সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখল, ভবন নির্মাণ (ডেভেলপার) প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন খাতে চাঁদাবাজি করার অভিযোগ আছে। সূত্রগুলো বলছে, চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে জোন-ভেদে ক্যাডার তৈরি করেছেন ইমন। সমপ্রতি চাঁদার টাকা না পেয়ে নিউমার্কেটের টয়লেটের টেন্ডার নিয়ে হামলা করে ইমন গ্রুপ। আগে দক্ষিণের সাবেক মেয়র তাপসের ছত্রছায়ায় কারাগারে বসে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা অনুর সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে এসব এলাকার অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন ইমন ও তার অনুসারীরা। সমপ্রতি দুই রবির (রবিউল আলম ও রবিউল ইসলাম) কাঁধে ভর করে অপরাধের নতুন সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। গত ১০ই অক্টোবর হাতিরঝিল থানাধীন মহানগর প্রজেক্ট এলাকায় বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে দীপ্ত টেলিভিশনের সমপ্রচার বিভাগের কর্মকর্তা তানজিল জাহান ইসলাম তামিম হত্যাকাণ্ডে জড়িতরাও ইমনের ঘনিষ্ঠ বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে।
গত ৫ই জানুয়ারি জিগাতলা ধানমণ্ডি ১৪ নম্বর এবং ৭/এ তিনটি বাড়িতে একযোগে ইমনের তিন সহযোগী তাণ্ডব চালিয়ে বহুতল নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। ককটেল নিক্ষেপ ও এলোপাতাড়ি গুলিতে একজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হন। নবাবগঞ্জ বেড়িবাঁধ সংলগ্ন সেকশন ইজিবাইক স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ করেন ইমনের হয়ে। চাঁদার টাকা না পেয়ে গত সপ্তাহের মধ্যরাতে এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনের সড়কে প্রকাশ্যে দুই কম্পিউটার ব্যবসায়ী নেতাকে কুপিয়েছে ইমনের ক্যাডাররা। ওই হামলায় আহত এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. ওয়াহিদুল হাসান দীপু হাসপাতাল ছাড়লেও গুরুতর আহত হয়েছেন মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের (ইসিএস কম্পিউটার সিটি) যুগ্ম সদস্য সচিব মো. এহতেসামুল হক। এ ঘটনায় দীপু যে মামলা করেছেন সেখানে ইমন ও তার সহযোগীদের আসামি করেছেন। মামলার যিনি বাদী হয়েছেন তিনি পিচ্চি হেলালের ভাই। মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সাধারণ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে মাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। সার্ভিস চার্জের নামে মার্কেটে থাকা ৮ শতাধিক দোকান থেকে কমপক্ষে ৫ হাজার করে চাঁদা তোলা হয়, যা বেশির ভাগই যায় সমিতির নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের ব্যক্তিদের পকেটে। গত ৫ই আগস্টের পর মাল্টিপ্ল্যান কম্পিউটার সিটি মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নতুন গ্রুপের হাতে চলে যায়। তারাই মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতি দখল করে। এই গ্রুপটি মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের আশীর্বাদপুষ্ট। তাদেরই প্রতিপক্ষ ইমনের গ্রুপ। মূলত চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করেই এই হামলা।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০০০ সালের পরে সরকার যে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ঘোষণা করেছিল, তাদের অন্যতম ছিলেন সুব্রত বাইন। তার নামে এখনো ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। ইতিহাস বলে, মূলত নব্বইয়ের দশকে মগবাজারের বিশাল সেন্টার ঘিরেই উত্থান হয় সুব্রত বাইনের। তিনি এই বিপণিবিতানের কাছে চাংপাই নামে একটি রেস্টুরেন্টের কর্মচারী ছিলেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে অপরাধজগতের সঙ্গে জড়িয়ে যান। পরে বিশাল সেন্টারই হয়ে ওঠে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনার কেন্দ্র। এজন্য অনেকে তাকে ‘বিশালের সুব্রত’ নামেও চেনেন। সরকার পতনের পর সুব্রত বাইন সরকারি অফিসের টেন্ডার, বিভিন্ন টাকা আদায়ের সম্ভাব্য খাতের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। গত ২৯শে সেপ্টেম্বর রাজধানীর মগবাজারের বিশাল সেন্টারে দলবল নিয়ে মহড়া দিয়েছেন বাইন। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর কিলার আব্বাসও প্রকাশ্য তৎপরতা চালাচ্ছেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ দুবাই বসে তার সহযোগীদের দিয়ে খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকার অপরাধ, চাঁদাবাজি, দখলবাজির কলকাঠি নাড়ছেন। তাকেও ঘিরেও বেশ আতঙ্ক বিরাজ করছে।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দাপিয়ে বেড়ানো সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের ভাই শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফের দাপট সাম্প্রতিক সময়ে কমেছে। মোহাম্মদপুর এলাকার অপরাধজগতের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল জোসেফ ও তার সহযোগীদের। সর্বশেষ জোসেফের হয়ে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন তার ভাই আনিস আহমেদের ছেলে সাবেক কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ। আত্মগোপনে চলে যাওয়াতে জোসেফ ও আসিফের তৎপরতা নাই। এসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন পিচ্চি হেলাল। এই এলাকার আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার বাদলও এখন সক্রিয়। যে কারণে পিচ্চি হেলাল ও কিলার বাদলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। সমপ্রতি মোহাম্মদপুরের কয়েকটি সংঘাত-সহিংসতার পেছনে দুইপক্ষের দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে এসেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক গত মঙ্গলবার বলেছেন, জামিনে কারামুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলাল ও সানজিদুল ইসলাম ইমনকে দ্রুতই আইনের আওতায় আনা হবে। কোনো সন্ত্রাসী আইনের আওতা থেকে রক্ষা পাবে না।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন তাদের গতিবিধি ও কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখার দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কিন্তু তাদেরকে নজরদারিতে যে একেবারেই রাখা হচ্ছে না সেটি আমরা গত চার মাসের অপরাধ চিত্র দেখলেই বুঝতে পারি। অপরাধের ধরনে পরিবর্তন এসেছে এবং মাত্রাও বেড়েছে। জামিনে বের হয়ে একই কাজ করছে আবার নতুন করে গ্যাং তৈরি করে অপরাধ করছে। কে কোন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করবে সেটি নিয়ে সংঘাত সহিংসতা আছে। তিনি বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা, তাদেরকে সংশোধন ও নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রক্রিয়া আমাদের যথেষ্ট দুর্বল। দুর্বল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো পদক্ষেপকেই তারা তোয়াক্কা করছে না। তারা মনে করছে মামলা করে গ্রেপ্তার করে তাদেরকে কারাগারে নিয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে আবার অপরাধ করা যাবে। তাই অপরাধীরা কারাগারে থাকুক আর বাইরে থাকুক অপরাধ সমানতালে করবে। সমস্যাটা হলো প্রচলিত আইনের মাধ্যমে আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারছি না।
আপনার মতামত জানানঃ