বাংলাদেশে ক্রমশ বাড়ছে ভারত বিরোধিতা। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে বাড়ছে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক। তবে এতদিন ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। তবে এবার তাতে লেগেছে রাজনীতির ছোঁয়া। ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাককে সমর্থন করেছে বিএনপি ও সহযোগী দলগুলি। এদিকে ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি কমছে। এই দুইয়ের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কিনা, এখন সেটাই খতিয়ে দেখতে হবে।
করোনার পর টানা দুই অর্থবছর ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। বৈশ্বিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যেও গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে বাজারটিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের রপ্তানি ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এরপর রপ্তানিতে ছন্দপতন ঘটে। চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত বাজারটিতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাস জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে ভারতের বাজারে ১২৭ কোটি ডলারের বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ১৫৩ কোটি ডলারের পণ্য। এর মানে চলতি অর্থবছরে ইতিমধ্যে রপ্তানি কমেছে ১৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভারতের বাজারে রপ্তানি হওয়া শীর্ষস্থানীয় বাংলাদেশি পণ্যগুলো হচ্ছে—তৈরি পোশাক, পাট ও পাটের সুতা, হোম টেক্সটাইল, সয়াবিন তেল, হিমায়িত মাছ, প্লাস্টিক ইত্যাদি। সার্বিকভাবে রপ্তানি কমার ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে তৈরি পোশাকের রপ্তানি ২৩ শতাংশ কমে যাওয়া। কারণ, ভারতে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের প্রায় ৫০ শতাংশই তৈরি পোশাক।
অন্যদিকে রপ্তানি কমলেও ভারতের বাজার থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি বাড়ছে। দেশটির বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ মাসে ৫৩৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ৪৯২ কোটি ডলার। তার মানে চলতি অর্থবছরের জুলাই–জানুয়ারিতে আমদানি বেড়েছে ৯ শতাংশ।
জানা যায়, ভারত ২০১১ সালে বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়। যদিও সেটা তেমন কাজে লাগাতে পারছিল না বাংলাদেশ। ২০১১ সালের দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়েও অর্থ দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট। সে জন্য কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়ে। যদিও পরবর্তী সময়ে ভারতের বিভিন্ন শহরে পোশাকের নামীদামি বিদেশি অনেক ব্র্যান্ড বিক্রয়কেন্দ্র খোলায় তাতে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পায়।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতে ৪২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। পরের বছর সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ কোটি ডলার। গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ১০১ কোটি ডলারের। তাতে দেখা যায়, দুই বছরের ব্যবধানে ভারতে তৈরি পোশাক রপ্তানি দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ফলে বাজারটিকে সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখা হয়।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে মোট ৫৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭৫ কোটি ডলার। সেই হিসাবে এবার রপ্তানি কমেছে ২২ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান গত বুধবার বলেন, ‘ভারতের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জন্য বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে রপ্তানি কমে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ বলা কঠিন। সামগ্রিকভাবে তাদের আমদানি কমেছে। আবার তারা তৈরি পোশাকের এই বাজার ধরতে নিজেদের সক্ষমতাও বাড়াচ্ছে। তারপরও আমাদের প্রত্যাশা, এক বছরের মধ্যে এই বাজারে আমরা ঘুরে দাঁড়াব। হয়তো রপ্তানি খুব বেশি বাড়বে না, আগের কাছাকাছি থাকবে।’
তৈরি পোশাক ছাড়াও পাট ও পাটসুতা রপ্তানি কমেছে ১ শতাংশের মতো। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে ১৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের পাট ও পাটসুতা রপ্তানি হয়েছে, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এ ছাড়া হোম টেক্সটাইল পণ্যের রপ্তানি কমেছে সাড়ে ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৭ কোটি ৫৯ লাখ ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়। তবে এই সময়ে চামড়া পণ্য ও জুতা রপ্তানি বেড়েছে।
অবশ্য বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতের পণ্য আমদানি কমেছে। ভারত তাদের অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস এপ্রিল-জানুয়ারিতে মোট ৫৬ হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬০ হাজার ১৪৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ তাদের আমদানি কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। এসব তথ্য ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের।
জানতে চাইলে বাংলাদেশের বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের পণ্য রপ্তানি কমেছে। তারই অংশ হিসেবে ভারতে রপ্তানি কমেছে নাকি অন্য কোনো কারণ আছে, সেটি খতিয়ে দেখতে বিজিএমইএসহ অন্যদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করব।’
আপনার মতামত জানানঃ