নির্বাচন শেষ হওয়ার একদিন পর ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এসেছিলেন কূটনীতিকদের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ‘মিট অ্যান্ড গ্রিট’ অনুষ্ঠানে। খানিকটা চুপচাপ পিটার হাস কিছুক্ষণ কথা বললেন পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে। তারপর পশ্চিমা কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কিছু আলাপ।
এরপর আসন গ্রহণের পালা। সামনের কয়েক সারি তখনো ফাঁকা। তবে পিটার হাস বসলেন বেশ দূরে, পঞ্চম সারিতে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর যে চাপ, সেখানে অবশ্য সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমে মানবাধিকার লংঘনের দায়ে র্যাবের উপরে নিষেধাজ্ঞা, পরে অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে ভিসা নীতির প্রয়োগ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রধান বিরোধী দল ছাড়া যে নির্বাচন হয়েছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন। এছাড়া জাতিসংঘও প্রশ্ন তুলেছে।
কিন্তু এরপর কী? যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলো কি আগের মতই বাংলাদেশের সঙ্গে বহুপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নেবে? নাকি কোন জটিলতা আসতে পারে?
আওয়ামী লীগ সরকারের এখানে চ্যালেঞ্জটা কোথায়? এমন সব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
‘বৈধতার সংকট’ থাকবে?
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর খুব দ্রুতই এই বিজয়কে অভিনন্দন জানিয়েছে ভারত, চীন, রাশিয়া। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ৫০টির বেশি দেশ অভিনন্দন জানিয়েছে।
এমনকি ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা জাপানের রাষ্ট্রদূতও অভিনন্দন জানানোর জন্যে গণভবনে গিয়েছিলেন। জাপান আমেরিকার কৌশলগত মিত্র।
প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন ঢাকায় নিযুক্ত অন্যান্য দেশের কূটনীতিকদের মতো যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটাস হাস নিজেও বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন।
সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আরো কয়েকজন মন্ত্রীর সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
আওয়ামী লীগ এর আগে বাংলাদেশে দুই দুইটি বিতর্কিত নির্বাচন করেও ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে। দেশে-বিদেশে বৈধতার কোন সংকট সেসময় সেভাবে তৈরি হয়নি।
কিন্তু এবার নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার যে প্রতিক্রিয়া, সেটা আওয়ামী লীগ সরকারের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে ‘ভিন্ন ইঙ্গিত’ দিচ্ছে বলেই অনেকে মনে করছেন।
“সরকার তো গঠিত হয় নির্বাচনের ভিত্তিতে। তারা (আমেরিকা-ব্রিটেন) বলেছে নির্বাচনটা যথাযথ হয়নি। আপনি এ দুটোকে বিচ্ছিন্নভাবেও দেখতে পারেন। আবার যদি কেউ এ দুটোকে মিলিয়ে দেখে তাহলে তো তখন এই বৈধতার সংকট থেকেই যাচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার টার্ক যে বিবৃতি দিয়েছেন, সেখানে বাংলাদেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার এবং আটকাবস্থায় মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রকৃত ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রে’র জন্য সরকারকে ‘গতিপথ পরিবর্তন’ করতে হবে।
অন্যদিকে আমেরিকার বিবৃতিতে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’। আর ব্রিটেন বলেছে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য যে বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি দরকার, বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় সেসব মানদণ্ড ধারাবাহিকভাবে মেনে চলা হয়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে একটা বিষয় লক্ষনীয় যে সেখানে বাংলাদেশের জনগনের সঙ্গে কাজ করার কথা বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের কথা বলা হয়নি।
“কেননা যে সরকারকে তারা মনে করছেন যে, সরকারটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হয়নি। অর্থাৎ তাদের যে পাবলিক ম্যান্ডেট সেটা নেই। তার সঙ্গে তাহলে তারা কিভাবে কাজ করবেন।”
“এ প্রশ্নটি আমেরিকাকে মোকাবেলা করতে হবে। ফলে আগামীতে কী হবে, পাঁচ বছরের জন্যই এটা একটা স্থির জায়গায় চলে গেছে আমি সেটা মনে করছি না। সবেমাত্র নির্বাচন হয়েছে। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটা ইতিবাচক নয়। ফলে এগুলো কিন্তু ভিন্ন রকম ইঙ্গিত দেয়,” বলেন মি, রীয়াজ।
নির্বাচন আমেরিকার চোখে ‘গ্রহণযোগ্য’ না হওয়ায় দেশটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোন কঠোর পদক্ষেপ নেবে কি-না বা কী করবে সেটা বুঝতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে বলেই মনে করেন আলী রীয়াজ।
কোন বিষয়ে ‘চাপ’ আসবে?
গণতন্ত্র, সমাবেশের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা যার মূল কেন্দ্রে থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু এবার এটাও একটা বাস্তবতা যে, ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বের ভূ-রাজনীতি অনেকটা বদলে গেছে। বিশ্বে আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে চীন-রাশিয়া। বিদেশ নীতিতে ইউরোপের মধ্যেও অনৈক্য আছে।
এর মধ্যেই ইসরায়েল হামাস যুদ্ধ এবং আমেরিকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন -এই দুইয়ে মিলে মার্কিন প্রেসেডিন্টের সামনে অনেক ইস্যু। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর এসব কিছুর ব্যস্ততায় এবং পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশকে কতটা মার্কিন নীতির অগ্রাধিকারে রাখবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
“যুক্তরাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকা। সেখান থেকে তারা এ মুহূর্তে সরে যাবে সেরকম লক্ষণ আমি দেখতে পাই না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য,” বলেন অধ্যাপক রীয়াজ।
“নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২৮ অক্টোবরের পরে আমার মনে হয়, আমেরিকা এক কদম পিছিয়ে গেছে। কিন্তু এক কদম পিছিয়ে যাওয়া কি কৌশলগত? তারা কি দেখতে চায় যে সাতই জানুয়ারি এবং এর পরে কী ঘটলো?
“ভারতের পক্ষ থেকে যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাস দেয়া হয়েছে, সেগুলো পালিত হচ্ছে কি-না। সে প্রশ্নগুলো কিন্তু আমরা এড়াতে পারছি না। ফলে একটু সময় নিয়ে দেখতে হবে সামনে কী ঘটে।”
আপনার মতামত জানানঃ