ডলার সংকটের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় চাপে পড়েছে অর্থনীতি। পরিস্থিতি সামাল দিতে শর্ত দিয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এতে করে বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কম হচ্ছে। তবে এখন দেশে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় আর্থিক হিসাবের বড় ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘাটতির কারণে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
মূলত আমদানিতে বিভিন্ন নীতিগত শর্ত দেওয়ার কারণে দেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি কিছুটা কমছে। চলতি হিসাবের পরিস্থিতিও উন্নতি হয়েছে। তবে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে আর্থিক হিসাবে। এর মূল কারণ, যে হারে দেশে বিদেশি ঋণ আসছে তার চেয়ে বেশি আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে দেশের সামগ্রিক লেনদেনেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
দেশের আর্থিক হিসাব গণনা করা হয় বৈদেশিক আর্থিক সম্পদ ও দায় থেকে। এখানে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ, পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, অন্যান্য বিনিয়োগ ও রিজার্ভ সম্পদ। বিনিয়োগের ধারা (সম্পদ ও দায়), বিনিয়োগের দলিল (ইকুইটি, বন্ড, নোটস এবং ঋণ) এ হিসাবের আওতায় আসে।
ব্যাল্যান্স অব পেমেন্টের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এক হাজার ২৯৩ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এ সময় আমদানি হয়েছে এক হাজার ৪৭৫ কোটি ডলারের পণ্য। এতে করে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ১৮১ কোটি ৮০ লাখ (১ দশমিক ৮১ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১১১ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ২০ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।
ডলার সংকট কাটাতে নানা উপায়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের জুলাই থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানির শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। একইসঙ্গে তুলনামূলক কম প্রয়োজন বা বিলাসী পণ্যের এলসি খোলার সময় ৭৫ থেকে শতভাগ পর্যন্ত নগদ মার্জিনের শর্ত দেওয়া আছে। এ মার্জিনের টাকা দিয়ে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণও নেওয়া যাবে না। এছাড়া বড় এলসি খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে তথ্য নিয়ে তার সঠিকতা যাচাই করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ডলার সংস্থান করা ছাড়া ব্যাংকগুলোকে এলসি খুলতে মানা করা হয়েছে। এর প্রভাবে গত অর্থবছরে আমদানি ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে, রপ্তানি বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বৈদেশিক বাণিজ্যের আর্থিক হিসাবে ৩৯২ কোটি ৯০ লাখ ডলার ঘাটতি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের ৮৪ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খাত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক হিসাব ভালো রাখাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই সূচকের ওপরই দেশের ঋণমান নির্ভর করে। আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন না। ঋণ দেওয়ার সময় বিভিন্ন শর্তজুড়ে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত।
ঘাটতির কারণ হিসাবে কর্মকর্তারা জানান, আমদানি কমলেও আশানুরূপ রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় আসছে না। বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া ও আগের দেনা পরিশোধ বেড়ে যাওয়া এ ঘাটতির সৃষ্টি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পরিশোধ ঝুঁকি এড়াতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রচুর পরিমাণ ডলার বিক্রি করছে। ফলে রিজার্ভও ধারাবাহিক কমছে।
এ অবস্থা সৃষ্টির কারণ কী?
গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি। দুই বছরে তা প্রায় ৩০ শতাংশ। এক বছর আগে ১ ডলার কিনতে খরচ হয়েছে ৯৫-১০০ টাকা, ২ বছর আগে ছিল ৮৪-৮৬ টাকা। সবশেষ বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১১১ টাকা। একদিন আগে বুধবারও এক ডলারে ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। এ নিয়ে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের ষষ্ঠবারের মতো ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হলো। অর্থবছরের শুরুতে অর্থাৎ জুলাইয়ে ডলারের দাম ছিল ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা এবং এক বছর আগে গত নভেম্বরে ছিল ১০১ টাকা ৩৮ পয়সা। চলতি অর্থবছরে চার মাসে টাকার দরপতন হয়েছে ২ টাকা ৩০ পয়সা, আর এক বছরে কমেছে প্রায় ১০ টাকা।
এমন অবস্থায় ডলারের দাম সামনে আরও বাড়বে এই আশঙ্কায় দেশি উদ্যোক্তারা বিদেশি ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। উল্টো আগের নেওয়া ঋণ শোধ করছে। অনেকে খরচ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় মেয়াদ বাকি রয়েছে, এমন ঋণও শোধ করে দিচ্ছে। এর ফলে গত দেড় বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৫০০ কোটি ডলার বিদেশে পাঠাতে হয়েছে। এ সময় রপ্তানি আয় খুব বাড়েনি। আবার গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার দেশে আনেননি রপ্তানিকারকরা। হুন্ডি ও অর্থপাচারের কারণে রেমিট্যান্স আশানুরূপ আসছে না। ফলে
চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো।
সবশেষ তথ্য বলছে, জুলাই ও সেপ্টেম্বরে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ কোটি ২০ ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এই হিসাব ঘাটতি ছিল ৩৬৮ কোটি ডলার।
সামগ্রিক লেনদেনে (ওভারঅল ব্যাল্যান্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ সূচকটি আগের বছর একই সময় ঘাটতি ছিল ৩৩১ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
আলোচিত সময় ৫০৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগের বছর একই সময় পাঠিয়েছিলেন ৫৮১ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন বছরে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে রেমিট্যান্স কমেছে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) সামান্য বেড়েছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ যেখানে ১৪৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল। চলতি অর্থবছরে একই সময় এসেছে ১৪৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়।
আলোচিত অর্থবছরে নিট বিদেশি বিনিয়োগ সামান্য বেড়েছে। এ সূচকটি আগের বছরের চেয়ে ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেড়ে ৫২ কোটি ৫০ লাখ ডলার হয়েছে। আগের অর্থবছরে এ সময় নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৫০ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
একইসঙ্গে আলোচিত সময়ে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফলিও ইনভেস্টমেন্ট) ৪ লাখ ডলার কমে গেছে। তার আগের অর্থবছরের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছিল এক লাখ ৭০ হাজার ডলার।
দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যে কারণে টাকার বিপরীতে বাড়ছে ডলারের দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে রিজার্ভ।
২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি বা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেই রিজার্ভ (১ নভেম্বর) কমে হয়েছে ২ হাজার ৬৪২ কোটি (২৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন) ডলারে। আন্তর্জাতিক হিসাবপদ্ধতি ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম ৬)’ অনুযায়ী, রিজার্ভ বর্তমানে ২ হাজার ৬৬ কোটি (২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন) ডলার।
এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন যে পরিমাণ প্রকৃত রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো কষ্টকর। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন নেতিবাচক। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ।
আপনার মতামত জানানঃ