পৃথিবীর সৌরজগতের বাইরে ‘পানির চাদরে ঢাকা’ দুটি নতুন গ্রহ আবিষ্কারের দাবি করেছেন একদল মহাকাশ বিজ্ঞানী। প্রসঙ্গত, এই প্রথম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পৃথিবী ছাড়া ভিন্ন কোনো ‘পানি জগৎ’ আবিষ্কারের দাবি করলেন গবেষকরা।
মহাবিশ্বে এমন গ্রহের অস্তিত্ব এতদিন তত্ত্বীয় ধারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল; গবেষকরা যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ দিয়ে এমন কোনো গ্রহের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে পারেননি এর আগে।
পৃথিবী থেকে ১৫০ আলোকবর্ষ দূরে আরেক সৌরজগতে দুটি বড় গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আয়তনে প্রায় জুপিটারের সমান ওই দুই গ্রহ নিয়ে গবেষণায় প্রাণের অস্তিত্বও মিলতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা। সম্প্রতি অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক অস্ট্রেলীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্টিফেন কেইন বলেন, পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের ভূমিকা রয়েছে।
নতুন ওই গ্রহের ক্ষেত্রেও এমন কোনো বিষয় থাকতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি। হয়তো সেখানেই প্রাণের অস্তিত্ব থাকার মতো পরিবেশ রয়েছে অথবা অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের ব্যাপারে তাদের ভূমিকা রয়েছে। তবে বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়; এ ব্যাপারে বিস্তর গবেষণা ও তথ্য-প্রমাণ প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, সৌরজগতের বাইরে অনেক গ্রহ-নক্ষত্রে পানির উপাদান থাকার লক্ষণ দেখা গেছে। তবে সেখানে প্রাণীর বসবাসযোগ্য পরিবেশ আছে কি না, তা নিশ্চিত নয়। নতুন এই দুই গ্রহ সে ক্ষেত্রে গবেষকদের জন্য নতুন আশার সৃষ্টি করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার অ্যাস্ট্রোনমিতে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে গবেষকরা লিখেছেন, পৃথিবীর সৌরজগৎ থেকে প্রায় ২১৪ আলোকবর্ষ দূরের এক সৌরজগতে কেপলার-১৩৮সি এবং কেপলার-১৩৮ডি নামের গ্রহ দুটির অবস্থান।
একটি লাল বামন নক্ষত্র ঘিরে চক্কর দিচ্ছে গ্রহ দুটি। আর এদের আবিষ্কারে ভূমিকা রেখেছে নাসার হাবল আর অবসের থাকা স্পিটজার টেলিস্কোপ।
আকারে পৃথিবীর দেড় গুণ বড় হলেও গ্রহ দুটির ভর পৃথিবীর প্রায় দ্বিগুণ বলে গবেষকরা ধারণা করছেন। আকার ও ভরের এই হিসেবের কারণেই গ্রহ দুটির গল্প কিছুটা জটিল হয়ে উঠেছে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে গবেষণা প্রতিবেদনের সহ-লেখক, ইউনিভার্সিটি অফ মন্ট্রিয়ালের অধ্যাপক বিয়র্ন বেনেকি বলেন, “আমাদের আগের ধারণা ছিল যে পৃথিবীর চেয়ে আকারে কিছুটা বড় গ্রহগুলো আদতে পাথর আর বড় আকারের ধাতব বল ছাড়া কিছু নয়। এ কারণেই ওই গ্রহগুলোকে আমরা সুপার আর্থ বলে ডাকতাম।”
প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট সিনেট লিখেছে, অনলাইন ‘এক্সোপ্লানেট’ তালিকাতে নাসা এখনও কেপলার-১৩৮ডি’কে ‘সম্ভবত পাথুরে গ্রহ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রেখেছে।
পৃথিবীর সূর্য নয়, ভিন্ন কোনো নক্ষত্রকে ঘিরে চক্কর দেয় এমন সব গ্রহকে এক নামে চিহ্নিত করতে ‘এক্সোপ্লানেট’ শব্দটি ব্যবহার করেন গবেষকরা।
অধ্যাপক বেনেকি বলেন, “আমরা এবার প্রমাণ দেখিয়েছি যে ওই গ্রহ দুটি, কেপলার-১৩৮সি এবং ডি অনেকটাই ভিন্ন। গ্রহ দুটির আয়তনের একটা বড় অংশ জুড়ে সম্ভবত পানি।”
তবে, সম্ভবত নীল সাগর নয়, উত্তপ্ত বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়ানো জলীয় বাষ্প ঢেকে রেখেছে গ্রহ দুটিকে।
গবেষক দলের প্রধান এবং ইউনিভার্সি অফ মন্ট্রিয়ালের ক্যারোলিন পলেট বলেন, “কেপলার-১৩৮সি এবং কেডলার-১৩৮ডি গ্রহ দুটির বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা সম্ভবত ফুটন্ত পানির চেয়েও বেশি এবং আমরা গ্রহ দুটিতে ঘন জলীয় বাষ্পের স্তর প্রত্যাশা করছি।”
জলীয় বাষ্পের বায়ুমণ্ডলের নিচে তরল পানি থাকার সম্ভাবনাও ফেলে দিচ্ছেন না গবেষকরা। কেপলার জুটিকে তারা তুলনা করছেন বৃহস্পতি আর শনির চাঁদ ইউরোপা আর এনসেলাডাসের সঙ্গে।
ওই দুটি উপগ্রহেও পানির অস্তিত্ব আছে বলে মনে করেন মহাকাশ গবেষকরা। তবে ওই দুই উপগ্রহের সঙ্গে কেপলার জুটির পার্থক্য হল, নিজ নক্ষত্রের অনেক কাছে অবস্থান করছে গ্রহ দুটি।
নাসার কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ গ্রহ দুটিকে চিহ্নিত করেছিল আগেই। কিন্তু এতোদিন গ্রহ দুটির বায়ুমণ্ডলের গঠন উপাদান নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি গবেষকরা। সে কাজে সহযোগিতা করেছে নাসার হাবল এবং অবসের থাকা স্পিটজার টেলিস্কোপ।
টেলিস্কোপে সরাসরি নীল পানি চোখে পড়েনি মহাকাশ বিজ্ঞানীদের। তবে, গ্রহগুলোর আকার ও ভর নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন তারা। সে তথ্য নিয়ে পরীক্ষাগারের মডেলের সঙ্গে তুলনা বিচার করে গবেষকরা বলছেন; গ্রহ দুটির আয়তনের একটা বড় অংশ গঠিত হয়েছে পাথরের চেয়ে হালকা কিন্তু হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম গ্যাসের চেয়ে ভারি কোনো উপাদান দিয়ে। সে কারণেই পানির কথা আসছে।
অধ্যাপক বেনেকি বলেন, “আমাদের যন্ত্রপাতি আর গবেষণা কৌশল যত উন্নত হতে থাকবে, আমরা সম্ভবত তত বেশি কেপলার-১৩৮সি এবং ডি-এর মত পানির জগতের সন্ধান পেতে থাকবো।”
এসডব্লিউ/এসএস/০৯১৩
আপনার মতামত জানানঃ